কবি মোহাম্মদ রফিকের কবিতা সমগ্র ও জীবনী

কবি মোহাম্মদ রফিকের কবিতা সম্পর্কে অনেকেই জানতে চাচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কবি মোহাম্মদ রফিক ছিলেন একজন বাংলাদেশী আধুনিক কবি, লেখক ও শিক্ষক।

তিনি একজন মননশীল আধুনিক কবি হিসাবে পরিগণিত যার আত্মপ্রকাশ ১৯৬০-এর দশকে। পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলন ও কবিতায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কাব্যিক রসদ যুগিয়ে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন।

কবি মোহাম্মদ রফিকের জীবনী

মোহাম্মদ রফিকের জন্ম ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ২৩ অক্টোবর বাগেরহাট জেলার বৈটপুরে। পিতার নাম সামছুদ্দীন আহমদ এবং মাতার নাম রেশাতুন নাহার। ঢাকা কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭১ সালে প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের ১ নং সেক্টরের কর্মকর্তা এবং পরে স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ-বৈশাখী পূর্ণিমা (১৯৭০), ধুলোর সংসারে এই মাটি (১৯৭৬), কীর্তিনাশা (১৯৭৯), খোলা কবিতা (১৯৮৩), কপিলা (১৯৮৩) ইত্যাদি। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি- প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪২০ এবং জাতীয় কবিতা পুরস্কার ২০১৪ ভূষিত হন।

কে এই কবি মোহাম্মদ রফিক

তখন ১৯৮৭ সাল, সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তুঙ্গে; তখন একটি কবিতা লিখেছিলেন কবি মোহাম্মদ রফিক। সেই কবিতার জন্য তাকে সেনানিবাসে ডেকে নেওয়া হয়েছিল, হুলিয়া নিয়ে আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল। আবার সেই কবিতা সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন চাঙা করতে জুগিয়েছিল রসদ।

সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অসম সাহসে দাঁড়ানো সেই কবি মোহাম্মদ রফিক রোববার ৮০ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। একুশে পদকজয়ী এই কবি দীর্ঘদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতার পর ২০০৮ সালে অবসর নিয়েছিলেন।

পাকিস্তান আমলে গত শতকের ষাটের দশকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, তখনই মোহাম্মদ রফিকের কাব্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে।

তখন সামরিক শাসক আইয়ুব খানবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন রফিক। এই কারণে সামরিক আদালতে তাকে কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছিল।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেনর রফিক, স্বাধীন বাংলা বেতারেও তিনি কাজ করেন।

স্বাধীনতার পর বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা শেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে যোগ দেন রফিক। তার কাব্য চর্চাও চলে।

  • জন্ম : ১৯৪৩, বৈটপুর, বাগেরহাট
  • মৃত্যু : ৬ আগস্ট, ২০২৩

কবি মোহাম্মদ রফিকের খোলা কবিতা

সেনা শাসক এরশাদেরও কবি হওয়ার সাধ জেগেছিল। ক্ষমতায় থাকাকালে তল্পিবাহকদের নিয়ে কবিতাকে প্রায় কুক্ষিগত করে রাখে। সেনা কবির সঙ্গীসাথীদের রাজকীয় কবির অভিধাও জুটেছিল। সেজন্যই কিনা কবি মোহাম্মদ রফিক লিখেছেন,
‘সব শালা কবি হবে;
পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই;
বন থেকে দাঁতাল শুয়োর
রাজাসনে বসবেই;’
(খোলা কবিতা)

কবি মোহাম্মদ রফিকের কবিতা সমূহ

কবি মোহাম্মদ রফিকের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতা এখানে দেওয়া হয়েছে-

গন্ধ আসে

আদিতম হনন উত্সবে
মৃত্যুই আমার উপহার,
খণ্ড দেহ, মস্তিষ্ক, করোটি,
ফুল-ফলে, সাজিয়ে থালায়,
যেন বা পুজোর উপচার,
দরগাহ্য় মোম ও লোবাণ,
চন্দনে চর্চিত মাংসঘ্রাণ;
পৌঁছে যাই, পরির প্রাসাদে,
কত যুগ পেরিয়ে, এই তো
যদি তার চক্ষু ছুঁয়ে যায়
করুণায়, আবেগে আর্দ্র বা
ঈষৎ হাসির রেখা ঠোঁটে,
হতে পারে, বিদ্রূপে বঙ্কিম;
তবু, চন্দ্রকান্তি খেলে যায়
অগ্নিদগ্ধ মল্লিকা বিতানে,
জন্মের শূন্যের শূন্য উপচে
পূর্ণ হবে, প্রাণের আরতি;
এ যে দেখি, শবের স্বদেশ,
শুধু আমি, শ্বাস নিতে পারি;
বাজছে শঙ্খ, মসজিদে আজান,
শুনি, শুনে মুচড়ে ওঠে দেহ;
তখনও বধির হু-হুঙ্কার,
লাভাস্রোত হিমানী রক্তের
ধোঁয়াকুয়াশায় মাংসঘ্রাণ;
যেন কোনো স্বর্গীয় আরক!

যাত্রা, প্রভাতিয়া

জলতরঙ্গে ভাসে-ডোবে লাশ,
বরযাত্রী, আকাশি-যাত্রায়;
ভৈরবীতে, সুর ভাঁজে ওঁম,
কোথায়, সে কবে, মৃত্যু হল,
শিশুকণ্ঠ গেয়ে ওঠে, জয়,
পাপড়ি ভেজে প্রভাতী শিশিরে,
ঠমকে, গমকে, মীড়ে, লয়ে,
মন্দ্রিত মেঘের জ্বালে হোম;
দিগ্বধূর দু’টি চক্ষু ছেয়ে
প্লাবিত আকাশ ধরণির;
এই জন্মে, অমর যাত্রায়
বরযাত্রী, স্বর্গের দুয়ারে
শঙ্খধ্বনি, সূর্যের রশ্মিতে
প্রভাতিয়া, চুম্বন বাতাসে;
আজ তবে, দু’চোখে মিলন
অন্তরীক্ষে, তোমাতে-আমাতে;
চক্ষুর চক্ষুতে সৌরলোক
রক্তধারা লাল রক্ত নীল,
এবার, আমাকে হত্যা করো,
তোমাকেও হত্যা করি আমি,
সংগমের, মঙ্গল শীৎকারে;
কালান্তর দেহান্তর কালে
দেহ, বৃষ্টিধোয়া, ভস্ম বালু,
শব্দহীন নি:শব্দের বোল
অকূলের নক্ষত্রমিনারে;
যাও পাখি, উড়ি উড়ে যাও,
পারিজাত, তড়পায় হৃৎপিণ্ডে,
হলুদিয়া মন্দির আসমানি;
ব্যর্থ নয়, বিরহ-বাসর!

গুবরে পোকা

গুবরে পোকা, বহু কষ্টে
আঁধার গহ্বর থেকে
পা-টেনে বেরিয়ে এসে
দাঁড়ায় প্রান্তরে, মুখ তুলে
বাতাসের শব্দ শোনে
স্পর্শ পায় রোদ্দুরের;

চতুর্দিকে ঝলমলে দিন,
গুবরে পোকা, আলোর অতিথি তুমি
কবিরও অতিথি!

নির্বাপণ

সে উৎসাহ মরে গেছে,

মরা-ইঁদুরের লেজ ধরে
শৈশবের বন্ধুদের তাড়া করে ফেরা

সেই সব প্রজাপতিদের পিছে-পিছে
গাছ-আগাছার ভিড়ে ছুটে চলা

দিন শেষে আঁধার ঘনিয়ে এলে
মন ভাঙা রঙ মেখে ঘরের দাওয়ায় উঠে আসা

দিন তো ফুরিয়ে যায় দিনের নিয়মে
রাত্রি তবে কারোই নিয়তি নয় শেষতক

আমি কিন্তু মরিনি এখনো।

শিশু

খোঁড়া হচ্ছিল কবর,
দৃশ্যটি দেখে শিশু জিজ্ঞাসা করে,
-আব্বা কী হচ্ছে ওখানে?
-কবর খোঁড়া হচ্ছে।
-কেন?
-তোমার দাদাকে মাটি দেয়া হবে।
-কেন?
-স্বর্গে যাবেন তাই।
-স্বর্গে গেলে কী হবে?
-পাপপূণ্যের বিচার হবে।
-আব্বা, আমি স্বর্গে যাব কবে?
-বৃদ্ধ হলে।
চিন্তায় পড়ে গেল শিশু।
হঠাৎ সে বলে উঠল কাঁদো কাঁদো স্বরে,
-আব্বা আমি স্বর্গে যাব না
দাদাও যাবে না
ওদের কবর খোঁড়া বন্ধ করতে বলো!
হতভম্ব পিতা শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল!

Rate this post

 সাবস্ক্রাইব

 দরকারি খবরাখবর ও তথ্য সবার আগে পেতে আমাদের ফেসবুক পেজসহ অন্যান্য সোশ্যল প্লাটফর্মগুলোতে Follow/Subscribe করুন।

Like/Follow our Facebook page

Subscribe our Instagram channel

Follow our Google news page

Subscribe our Youtube channel

সর্বশেষ আপডেট পেতে Edu Daily 24 এর Facebook পেজ, Google news পেজ ও Youtube চ্যানেল সাবস্ক্রাইব/ফলো করুন। নোটিফিকেশন পেতে APPও ইনস্টল করে রাখতে পারেন।

মন্তব্য করুন

You cannot copy content of this page