সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই থাকত যদি ছবির মতো সারি সারি কম্পিউটার, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নটা তাহলে অনেকটা স্পষ্ট হতো। কিন্তু হায়, বেশির ভাগ স্কুলে কম্পিউটারই নেই। কম্পিউটার থাকলেও আবার শিক্ষক নেই। অনেক স্কুলে কম্পিউটার কক্ষ আবার তালাবদ্ধই থাকে সারা বছর। বিস্তারিত জানাচ্ছেন আরাফাত শাহরিয়ার ও হাবিবুর রহমান তারেক
কম্পিউটার, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক_সবই আছে। নেই শুধু বিদ্যুৎ। বিদ্যুতের অভাবে কম্পিউটার শিক্ষক মনোয়ার হোসেনের বাড়িতে চলে পাঠদান! এভাবেই ৯ বছর ধরে চলছে রাজশাহীর দুর্গাপুরের রসুলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের কম্পিউটার শিক্ষা কার্যক্রম। এতে পাঠদান কার্যক্রম অনেকটাই ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শামসুল আলম। তিনি জানান, বিদ্যুতের জন্য বারবার আবেদন করেও সংযোগ মেলেনি।
দ্বীপাঞ্চলে শিক্ষক নেই
দ্বীপজেলা ভোলার বেশির ভাগ স্কুলেই কম্পিউটার নেই। যেসব স্কুলে কম্পিউটার রয়েছে সেসব স্কুলে কম্পিউটার শিক্ষক কিংবা প্রশিক্ষক নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অযত্ন-অবহেলায় ওই সব কম্পিউটার নষ্ট হওয়ার উপক্রম।
ভোলা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাকিরুল হক জানান, সরকার বিদ্যালয়ে সাতটি কম্পিউটার দিলেও কম্পিউটার শিক্ষকের পদ নেই। বিদ্যালয়ের কৃষি বিষয়ের শিক্ষক শাহ জামাল কম্পিউটার শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছেন!
একই চিত্র ভোলা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রাণ গোপাল দে জানান, কম্পিউটার প্রশিক্ষক না থাকায় ছাত্রদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জেলার জয়রা উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি কম্পিউটার থাকলেও তা ব্যবহার করা হয় অফিসের কাজে। প্রধান শিক্ষক আজাহারুল ইসলাম জানান, কম্পিউটার কোর্স চালু করার জন্য শিক্ষক নিয়োগ এবং একটি আলাদা শ্রেণীকক্ষ নির্মাণ করার পরও অনুমোদন পাওয়া যায়নি।
শহরের হালও বেহাল
রাজধানীর ধানমণ্ডি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকা বানু জানান, কম্পিউটার ক্লাসের জন্য ল্যাবের চারটি ডেস্কটপ কম্পিউটারই সম্বল। এই চারটির মধ্যে তিনটি সচল, যা ছাত্রীর তুলনায় মোটেই যথেষ্ট নয়।
ধানমণ্ডি গভ. বয়েজ হাই স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র মিনহাজ জানায়, ‘ব্যবহারিক ক্লাসের সুযোগ পাব না_এটা ভেবে এ বিষয় (কম্পিউটার) নিইনি।’
স্কুলটির প্রধান শিক্ষক গৌরচন্দ্র মণ্ডল বলেন, ‘কম্পিউটার শিক্ষার কোনো অভিজ্ঞ শিক্ষক না থাকলেও একটি ল্যাব আছে। যদিও ল্যাবের আটটি কম্পিউটারের বেশির ভাগই বিকল।’
এই তো কাছে মানিকগঞ্জ
মানিকগঞ্জের মত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে কম্পিউটার বেছে নিয়েছে প্রায় ১০০ শিক্ষার্থী। ভরসা ‘দানে পাওয়া’ একটি মাত্র কম্পিউটার। সেটিও আবার বেশির ভাগ সময় নষ্ট থাকে। আলাদা কক্ষ না থাকায় অফিস কক্ষেই রাখা হয়েছে যেনতেনভাবে। প্রধান শিক্ষক আবদুল জলিল জানান, এক মাসের প্রশিক্ষণ পাওয়া একজন শিক্ষক দিয়েই কাজ চালানো হচ্ছে।
লন্ডনি সিলেটেরও সেই দশা
সিলেটের জকিগঞ্জের চিত্রটাই বলে দেয় কম্পিউটার শিক্ষার বাস্তব অবস্থা। গোটা উপজেলায় কম্পিউটার শিক্ষক পদে কর্মরত রয়েছেন মাত্র দুইজন শিক্ষক! উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার জানান, উপজেলার ২২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ১৯টি মাদ্রাসার ৯টিতে বিদ্যুৎ সংযোগই নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ স্কুল-মাদ্রাসাতে কম্পিউটার কক্ষ তালাবদ্ধ থাকে। ধুলাবালিতে যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য কম্পিউটারগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে কাপড় দিয়ে। যেসব বিদ্যালয়ে কম্পিউটার কক্ষ নেই সেখানে প্রধান শিক্ষকের কক্ষেই শোভা পায় কম্পিউটার।
সরকারি অনুদান হিসেবে পাওয়া একমাত্র কম্পিউটারটির মুখ দেখেনি স্কুলের ছাত্রছাত্রীসহ অনেক শিক্ষকও। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার মির্জাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে কম্পিউটারটির খোঁজ পাওয়া যায়নি। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অখিল ভৌমিক জানান, কম্পিউটার শিক্ষক এবং কম্পিউটার স্থাপনের উপযুক্ত জায়গার অভাবেই এ সমস্যাটি হচ্ছে।
গৌরনদীতেও জোয়ার নেই
বরিশালের গৌরনদী শরিকল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোকলেচুর রহমান জানান, এ স্কুলে পাঁচটি কম্পিউটারের তিনটিই অকেজো! পাঠদানেও রয়েছে শিক্ষকদের অবহেলা। গৌরনদী আল হেলাল ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসায় গিয়ে কম্পিউটার শিক্ষক নজরুল ইসলামের সামনেই কথা হয় দশম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। আবদুল্লাহ মাহমুদ, ফরহাদ হোসেন, নাসরিন আক্তারসহ ক্লাসের অনেকেই জানায়, তাদের কোনো ক্লাস নেওয়া হয় না। নজরুল ইসলামের অজুহাত, অসুস্থ থাকায় তিনি পড়াতে পারেননি।
পর্যাপ্ত কম্পিউটার এবং অভিজ্ঞ শিক্ষক না থাকায় অনেক শিক্ষার্থীই কম্পিউটার শিক্ষা বিষয়ের পরিবর্তে অন্য বিষয়কে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে বেছে নিচ্ছে।
গৌরনদীর হোসনাবাদ আলিয়া মাদ্রাসায় গিয়ে জানা যায়, ২০০৪ সালে কম্পিউটার শিক্ষক হিসেবে মাহাবুব হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। মাদ্রাসার দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রাজিয়া আক্তার ও ইউসুফ হোসেন বলে, ‘স্যারে নিজেই কম্পিউটার বিষয়ে কিছুই জানেন না, মোগো কী পড়াইবে।’ মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট ফজলুল মৃধা এর সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘জাল সনদ জমা দিয়ে মাহাবুব চাকরি নেন। তাঁর কম্পিউটার সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই। দীর্ঘদিন তিনি স্কুলে অনুপস্থিত রয়েছেন।’
* প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন : রফিকুল ইসলাম, রাজশাহী; গিয়াস উদ্দিন মিয়া, গৌরনদী, (বরিশাল); শিমুল চৌধুরী, ভোলা; সাবি্বরুল ইসলাম সাবু, মানিকগঞ্জ; আল মামুন, জকিগঞ্জ (সিলেট) ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, শ্রীমঙ্গল
সূত্র: দৈনিক কালের কন্ঠ । সিলেবাসে নেই । তারিখ: ২৭-৪-২০১১