প্রসঙ্গ : বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বদলি


master জানুয়ারি ১১, ২০২০, ৪:২২ অপরাহ্ন / আপডেট: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৪, ১২:৫৯ অপরাহ্ন
প্রসঙ্গ : বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বদলি

মাছুম বিল্লাহ

যেকোনো সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মনোবল চাঙ্গা করার জন্য, নতুনভাবে কাজে উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য তাকে বদলি করা হয়। কারও পদোন্নতি হলে তার কাজের ধরন পরিবর্তন হয়, তার সেবাদানের ক্ষেত্র ও সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বেড়ে যায়। তাই পদোন্নতি হওয়ার সাথে সাথে তাকে বদলি করা হয়। কেউ কর্মক্ষেত্রে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়েছে, মানবিকতার খাতিরে তার স্থান পরিবর্তন করা হয় যাতে পরিচিতজনদের সামনে পড়ে তাকে লজ্জা পেতে না হয়। মানবিক কারণেও অনেক সময় অনেককে বদলি করা হয়, একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর পারিবারিক কারণেও বদলি করা হয়। চাকরিতে বদলির পেছনে এসব মহৎ ও কল্যাণকর উদ্দেশ্যাবলী নিহিত। কিন্তু বর্তমানে আমরা এটিকে স্বার্থসিদ্ধি লাভের, শত্রুতা উদ্ধারের, শাস্তি প্রদানের, অযথা ও অনভিপ্রেত সুবিধা প্রদানের, বিরোধীদল দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছি। ঢাকা শহরের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণ জনবল প্রয়োজন তার কয়েকগুন বেশি রয়েছে-সেটি হাসপাতাল হোক আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হোক। কারণ অযথা সুবিধা প্রাপ্তি ও অবৈধ অর্থ লেনদেনের কারণে। ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য অনেকেই ঢাকায় থাকতে চান। কাজেই যে যেভাবে পেরেছেন ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু ঐসব প্রতিষ্ঠানে সেবার মান কি বেড়েছে? জেলা, উপজেলার হাসপাতাল ও সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় জনবল এক তৃতীয়াংশও নেই। সবাই বিভাগীয় শহর কিংবা ঢাকামুখী। গ্রামের জনগণকে সেবা দেয়ার লোক নেই, কর্মকর্তা নেই।

মাছুম বিল্লাহ - Masum Billah

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বদলির জন্য বেশ কিছুকাল যাবৎ আন্দোলন করে আসছেন। শিক্ষকরা বলছেন, সরকার আমাদের একশত শতাংশ মূল বেতন দিচ্ছেন, কাজেই আমরা সরকারি চাকরির মতো বদলি আশা করতে পারি। তারা আরও বলেছেন যে, স্বেচ্ছাচারী ও রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা প্রভাবিত ম্যানেজিং কমিটির অধীন বেশিদিন চাকরি করা যায় না। তাতে, হয় শিক্ষকতার মহান ব্রতকে বিসর্জন দিতে হয়, না হয় চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। চাকরি ছেড়ে দেয়া যেহেতু কোনো সমাধান নয় বা সব সময় সম্ভবও না তাই বদলি এর একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান। কিন্তু আমরা তো জানি যে, একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অন্যটি থেকে আলাদা, পরিচালনা কমিটি আলাদা, প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সক্ষমতা আলাদা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সংখ্যা আলাদা। উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে তাদের কমন কোনো অথিরিটি নেই। যদিও উপজেলা পর্যায়ে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কিংবা জেলা পর্যায়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আছেন। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তাদের একক কোনো কর্তৃত্ব নেই। কর্তৃত্ব এখনও সেই ম্যানেজিং কমিটির ওপর। তাই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির বিষয়টি কীভাবে মীমাংসিত হবে?

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে দেশের কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেখানে হঠাৎ কাউকে তারা নিতে চাইবেন না। ঐসব প্রতিষ্ঠান থেকে দু’চারজন শিক্ষক যদি অন্য প্রতিষ্ঠানে বদলি হয়ে যেতে পারেন, তারা সেখানে তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে শিখে যাওয়া পজিটিভ কালচার অনেকটা চালু করতে পারেন যদি নতুন প্রতিষ্ঠান ও কমিটি সহায়তা করে। এসব ক্ষেত্রে একটি হতে পারে যে, অপেক্ষাকৃত দুর্বল পারফর্মিং কমিটি যদি তাদের প্রতিষ্ঠান আসলেই ভালো করতে চান এবং ভালো পারফর্ম করা কমিটিও যদি চান যে, দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের মতো হোক তাহলে তারা মিউচুয়ালি সেটি করতে পারেন। এজন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসার কিংবা জেলা শিক্ষা অফিসারকে বিষয়টি অবগত করা যেতে পারে। এখন যেহেতু অতিরিক্ত জেলা কমিশনার ( শিক্ষা) নামে একটি প্রশাসনিক পদ আছে, উনি পুরো বিষয়টি দেখভাল করতে পারেন।

তবে এসব সমস্যার সমাধান সহজেই হতে পারে যদি পুরো শিক্ষাকে সরকারিকরণ করা হয়। শিক্ষা সরকারিকরণ করা হলে, শিক্ষক কর্মচারীদের চাকরি সরকারি হবে, তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। কিন্তু শিক্ষার মানে যে পরিবর্তন হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেমন নেপালের শিক্ষকরা রাষ্ট্রীয় বেতন পান কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোর মান একেবারেই ভালো নয়। আমি ঢাকা সিটির দু’ একটি উদাহরণ দিতে পারি। একটি এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের কমিটি চাচ্ছে বিদ্যালয়টিকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে। তাই তারা বিভিন্ন ধরনের সহপাঠক্রমিক কাজ বিদ্যালয়টিতে চালু করতে চান। যেমন- বিজ্ঞান মেলা, গণিত মেলা, ল্যাংগুয়েজ ক্লাব ইত্যাদি। কিন্তু শিক্ষকরা তাতে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বরং তারা বিভিন্ন ধরনের বাধা সৃষ্টি করছেন যাতে এসব কাজ বিদ্যালয়টিতে না হয়। এগুলো হলে শিক্ষকদের কাজ বেড়ে যাবে এবং তাদের প্রাইভেট টিউশনিতে সমস্যা হবে। আবার এমপিওভুক্ত নয় এমন বিদ্যালয়ের মালিক বা কমিটি বিদ্যালয়টিতে অনেক কিছু চালু করেছেন এবং শিক্ষকরাও সেগুলো পালন করছেন। কারণ তাদের বেতন ভাতাদি নির্ধারণ করেন কমিটি তথা মালিক। তবে, শিক্ষকদের চাকরি সরকারিকরণ হতে হবে। কারণ প্রথমে তাদের অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা দূর করতে হবে। দ্বিতীয়ত, উপযুক্ত প্রার্থীরা যাতে এই সুবিধা পায় সেটি দেখতে হবে।

ঢাকাসহ বড় বড় সিটিতে কিছু ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। আর এসব প্রতিষ্ঠানে কয়েকজন শিক্ষক থাকেন যাদের কাছে বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য অভিভাবকরা ওইসব প্রতিষ্ঠানের পেছনে ছোটেন। তাই, এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সিটির মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত বদলির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এক ধরনের সমতা আসবে তেমনি অভিভাবকদের ব্যস্ততাও কমবে, শহরও অনেকটা যানজটমুক্ত হবে। বিশেষ কোনো কারণে বা শাস্তিমূলক বদলির ক্ষেত্রে এক শহর বা সিটি থেকে অন্য শহর বা সিটিতেও এটি চালু করা যায়। আবার মিউচুয়্যালিও এটি করা যায়। তবে, বেসরকারি শিক্ষকদের গণহারে সর্বত্র বদলির ব্যবস্থা করার পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি।

মাছুম বিল্লাহ : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক অধ্যাপক।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

BD Results App