ব্যাংকের ভাইভার এ টু জেড

সামনে পূবালী ব্যাংকের ‘অফিসার’ পদের ভাইভা। সব ব্যাংকের ভাইভায় প্রায় একই রকম প্রশ্ন করা হয়। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার আগে পূবালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরি করেছেন গাজী মিজানুর রহমান। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাংকের ভাইভাসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ নিয়ে তিনি লিখেছেন-

কিছু কমন প্রশ্ন :

► নিজের সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলুন। (বাংলায় জানতে চাইলে বাংলায়, ইংরেজিতে বললে ইংরেজিতে উত্তর দেবেন
► বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর কে?
► বর্তমান গভর্নর কততম গভর্নর?
► বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু আয় কত?
► বর্তমানে ব্যাংক রেট (Bank rate) কত?
► বর্তমানে ‘কল মানি রেট’ কত?
► ব্যাংক রেট ও কল মানি রেটের মধ্যে পার্থক্য কী?
► বর্তমানে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কত?
► মুদ্রাস্ফীতির হার কত?
► মুদ্রাস্ফীতি কেন হয়?
► মুদ্রাস্ফীতি দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো, নাকি খারাপ?
► মুদ্রাস্ফীতি একটি দেশের অর্থনীতিতে কিভাবে প্রভাব ফেলে?
► BACH কী?
► BACH-এর কয়টি অংশ থাকে?
► BACH-এর ক্ষেত্রে High Value এবং Regular Value কী?
► CTR & STR মানে কী?
► BAMLCO কী? BAMLCO-এর কাজ কী?
► LC কী?
► LC সাধারণত কত প্রকার ও কী কী?
► ব্যাংকগুলো কেন CSR কী?
► CSR কী?
► এক্সচেঞ্জ পজিশন কী?
► চেক কাকে বলে?
► চেক কয় প্রকারের হয়?
► CAMELS কী?
► পূবালী ব্যাংক কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়?
(প্রার্থী পূবালী ব্যাংক ছাড়া অন্য কোনো ব্যাংকে ভাইভা দিলে সে ব্যাংক সংশ্লিষ্ট খুঁটিনাটি জানতে হবে)
► পূবালী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা কে?
► পূবালী ব্যাংকের বর্তমান এমডির নাম কী?
► পূবালী ব্যাংকের বর্তমান শাখা কয়টি?
► বর্তমানে তফসিলভুক্ত ব্যাংক কয়টি?
► সর্বশেষ তফসিলভুক্ত ব্যাংকের নাম কী?
► বাংলাদেশে এত ব্যাংক থাকতে আপনি পূবালী ব্যাংকে চাকরি করতে আগ্রহী কেন?

আমার বেলায় যা হয়েছে :

আমি অনেক চাকরি পরীক্ষার ভাইভায় অংশগ্রহণ করেছি। চাকরি ভাইভার ক্ষেত্রে সাধারণ প্রস্তুতির পাশাপাশি মানসিক প্রস্তুতিটাও জরুরি। মানসিক বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য বলছি, ভাইভা বোর্ডে আপনাকে যেসব প্রশ্ন করা হবে তার সব আপনি পারবেন বা পারতে হবে বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। একজন মানুষের পক্ষে দুনিয়ার সব কিছু জানা কখনো সম্ভব নয়, এটা যাঁরা ভাইভা নিচ্ছেন, তাঁরাও ভালো করে জানেন। আর আপনি যদি ভাইভা বোর্ডে কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে না পারেন, তার জন্য কখনো নার্ভাস ফিল করবেন না। যেমন—আমি যখন ২০১৬ সালে পূবালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে ভাইভা দিতে গেলাম, ভেতরে ঢুকে দেখি ভাইভা বোর্ডে মোট ছয়জন। ভাইভা বোর্ডের প্রধান ছিলেন পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের তত্কালীন মহাব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)।

আমাকে প্রথমেই প্রশ্ন করা হলো, ‘হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও রোমানদের মধ্যে প্রথম কোন যুদ্ধ হয়েছিল?’ আমি প্রথমবার যে উত্তরটি দিলাম, তাঁরা সেই উত্তরটি নেননি। দ্বিতীয়বারের উত্তরটিও নিলেন না। তাঁরা বললেন, ‘আপনার উত্তরটি হয়নি।’ তখন বললাম, ‘স্যরি স্যার, তাহলে আমার এই প্রশ্নটির সঠিক উত্তর জানা নেই।’ তখন তাঁরা বললেন, ‘তাহলে এই প্রসঙ্গ থাক; অন্য প্রসঙ্গে যাই।’ আরেকজন প্রশ্ন করলেন, ‘বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নাম কী?’ উত্তরে বললাম, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’। তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘পূবালী ব্যাংক তো একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। আপনি পূবালী ব্যাংক বা অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান দুটি কাজের কথা বলুন।’ উত্তরে বললাম, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রাহকসেবার মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করা। সেই লক্ষ্যে পূবালী ব্যাংক গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে এবং সেই আমানত আবার অন্য গ্রাহকের কাছে নির্দিষ্ট মুনাফার শর্তে ঋণ হিসেবে বিতরণ করে। অর্থাৎ আমানত সংগ্রহ করা এবং সেই আমানত ঋণ হিসেবে বিতরণ করা পূবালী ব্যাংকসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের মূল কাজ। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক) প্রধান যে দুটি কাজ করে তা হলো—এর অধিভুক্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে মনিটরিং করে এবং ছয় মাস অন্তর অন্তর মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে।’ এরপর আরো কিছু প্রশ্ন করা হলো। সবশেষে যে প্রশ্নটি করা হয়েছিল, আমার মনে হয় চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে এটিই বেশ তাত্পর্যপূর্ণ। সেই প্রশ্নটি হলো, ‘আচ্ছা আপনি তো আর্টসের স্টুডেন্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্টস থেকে অনার্স-মাস্টার্স করেছেন। আজ আমাদের এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অনেক প্রার্থী এসেছেন বিবিএ, এমবিএ করা ব্যাংকিংয়ের ওপর, অ্যাকাউন্টিংয়ের ওপর, তাহলে আমরা কেন তাঁদের বাদ দিয়ে আপনাকে নেব?’

প্রশ্নটি বেশ জটিল। ঘাবড়ে না গিয়ে নিজেকে সামলে নিই। বললাম, ‘স্যার, যাঁরা ব্যাংকিং, অ্যাকাউন্টিং কিংবা বিজনেস স্টাডিসের অন্যান্য সাবজেক্টের ওপর বিবিএ, এমবিএ করেছেন; ব্যাংকিংয়ের ওপর তাঁদের মতো আমার ভাস্ট নলেজ (Vast knowledge) নেই, এটা সত্য। কিন্তু স্যার, তাঁরা পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদের পরীক্ষার জন্য ব্যাংক রিলেটেভ যে রকম বইপুস্তক পড়েন, যে রকম প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে এখানে ভাইভা দিতে এসেছেন, আমিও ঠিক একই রকম ব্যাংক রিলেটেড বইপুস্তক পড়ে একই প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে এখানে এসেছি। আমাকে যদি সিনিয়র অফিসার হিসেবে পূবালী ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁদের যেমন ট্রেনিং দেওয়া হবে, আমাকেও ঠিক একই ট্রেনিং দেওয়া হবে। আমি যদি তাঁদের মতো ট্রেনিং করি, তাহলে আমিও তাঁদের মতো কিংবা অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের চেয়ে ভালো করতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।’ এমন উত্তরে পুরো ভাইভা বোর্ড আশ্বস্ত হলো বলে মনে হলো। দেখলাম এমডি স্যার পাশের জনের সঙ্গে ফিসফিস করে কিছু বললেন। তারপর আমাকে বললেন, ‘আপনি তাহলে এখন আসতে পারেন।’ আমি সালাম দিয়ে চলে এলাম। আমার ভাইভার প্রায় ১৬ দিন পর ফল হলো, দেখলাম চাকরিটা হয়ে গেল।

পরামর্শ :

► ভাইভা বোর্ডে সুন্দর পোশাকে পরিপাটি হয়ে যাবেন।
► ভাইভা বোর্ডে নির্দিষ্ট সময়ের আগে রিপোর্ট করতে হয়। তাই অন্ততপক্ষে এক ঘণ্টা আগে পৌঁছার চেষ্টা করবেন।
► ভাইভা বোর্ডে কোনো প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে ভুল উত্তর কিংবা অযথা সময় নষ্ট না করে ‘স্যরি, এই প্রশ্নটির উত্তর আমার জানা নেই’ বলবেন।
► যে প্রতিষ্ঠানের চাকরির জন্য ভাইভা দিতে যাচ্ছেন, সেই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে, সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তি সম্পর্কে ও সেই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে যাবেন।
► যে পদের ভাইভা দেবেন, সেই পদের কাজ ও দায়িত্ব সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে যাবেন।
► অনার্স, মাস্টার্স যে বিষয়ের ওপর করেছেন, সেই বিষয়ের মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর ভালো ধারণা থাকতে হবে।
► অর্থ ও বাণিজ্যের সর্বশেষ আপডেট জেনে নেবেন।
► সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ঘটনাবলি সম্পর্কে জানাশোনা থাকতে হবে।
► ভাইভার আগের রাতে ফ্রেশ ঘুম দেবেন।
► নিজের হাতে কলম রাখবেন। দরকার হতে পারে।

সূত্র : কালের কণ্ঠ । চাকরি আছে । ১৫ মে ২০১৯