অনেকেই বিদেশে গবেষণা করতে যেতে চান। বিদেশে গবেষণার ক্ষেত্রও অনেক বেশি। বিষয়বস্তু কী হতে পারে, গবেষণার ধাপ, কিভাবে সুযোগ পাবেন−এ নিয়েই আমাদের এবারের মূল প্রতিবেদন। লিখেছেন হাবিবুর রহমান তারেক
বুয়েট থেকে পাস করে পড়াশোনার ইতি টানতে চাননি মাহফুজুল হাসান। তিনি এখন মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে (ইউটিএম) নগরায়ণের ওপর গবেষণা করছেন। মাস্টার্সের পর কোনো বিষয়বস্তুর ওপর পিএইচডি থাকলে সর্বত্রই মূল্যায়ন আছে_এমন যুক্তি থেকেই অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সিডনিতে পিএইচডির আবেদন করেছেন মিলাদ উদ্দিন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বছর অর্থনীতিতে মাস্টার্স করা এই শিক্ষার্থীর পছন্দের বিষয় ইকোনমিক ইম্প্যাক্ট অন হাউসহোল্ড। তিনি বলেন, ‘দেশে গবেষণার সীমাবদ্ধতা আছে, তাই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করছি।’
মিলাদ আরো জানান, দেশে গবেষণার ক্ষেত্র তিনটি ̶ সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিদেশি প্রকল্পের অর্থায়নে গবেষণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত প্রোগ্রামের (পিএইচডি, এমফিল) আওতায় গবেষণা। তবে বাংলাদেশে এর পরিধি ও সুযোগ_দুটিরই সীমাবদ্ধতা আছে। তাই শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও পিএইচডি-এমফিল পর্যায়ে গবেষণার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
গবেষণা কেন
সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে গভীর ধারণা পেতে এবং শিক্ষাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতার ভিত শক্ত করতেই গবেষণা। যে বিষয়বস্তুর ওপর গবেষণা করতে চাইছেন, পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ গবেষণা শেষে ওই বিষয়ের চাহিদা, গ্রহণযোগ্যতা কিংবা মূল্যায়ন কেমন হবে, তাও ভাবতে হবে। এ ছাড়া কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে, যেমন ̶ ফান্ড বা আর্থিক সহযোগিতা পাবেন কি না, ফান্ড না পেলে টিউশন ফি দিতে পারবেন কি না, পাঁচ-ছয় বছর গবেষণার ধৈর্য আছে কি না ইত্যাদি।
আবেদন করতে যা যা লাগবে
সাধারণত শিক্ষার্থীরা মাস্টার্সের বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়কেই গবেষণার মূল টপিকস হিসেবে নির্ধারণ করে। অনেক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত আবেদন করার সুযোগ থাকে। মাস্টার্স পাস করার পরই পিএইচডির জন্য আবেদন করা যাবে। আবেদন করতে দরকার হবে স্টেটমেন্ট অব পারপাস (দুই পৃষ্ঠার রচনা), রিকমেন্ডেশন লেটার বা সুপারিশপত্র, টোফেল অথবা আইইএলটিএস স্কোর (আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে জিআরই স্কোরও লাগে অনেক ক্ষেত্রে)।
আবেদনপত্র বাছাইয়ের পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের ঠিকানায় ভর্তি এবং ফান্ডিংয়ের প্রস্তাবপত্র (অফার লেটার) পাঠায়। পরবর্তী ধাপ ও করণীয়ও উল্লেখ থাকে ওই পত্রে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনেক সময় তুলনামূলক মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিমানভাড়া ও থাকার খরচ বহন করে থাকে।
স্টেটমেন্ট অব পারপাস লিখবেন দুই পৃষ্ঠায়
স্টেটমেন্ট অব পারপাস হলো দুই পৃষ্ঠার একটি রচনা, যেখানে নিজ সম্পর্কে বক্তব্য লিখতে হয়। কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে আগ্রহের কারণ, ওই বিশ্ববিদ্যালয় কেন নির্বাচন করলেন_এগুলো যৌক্তিকভাবে স্পষ্ট করে লিখতে হয় ওই রচনায়। আবেদনপত্র বাছাইয়ের সময় রচনাটির বক্তব্যের যৌক্তিকতা মূল্যায়ন করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আলাবামার বাংলাদেশি অধ্যাপক রাগিব হাসান জানান, অনেকেই আবেদনের সময় ইন্টারনেট থেকে নমুনা সংগ্রহের পর সেটাকেই সামান্য পরিবর্তন করে স্টেটমেন্ট অব পারপাস হিসেবে চালিয়ে দেয়, যা আবেদনপত্রটি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
স্টেটমেন্ট লেখার পর অভিজ্ঞ কাউকে দেখিয়ে নেওয়াটাই ভালো। প্রচলিত ও সহজ শব্দ নির্বাচন এবং বানানের ব্যাপারে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য বাদ পড়ল কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে। পাঁচ-ছয় প্যারার মধ্যেই বক্তব্য শেষ করা ভালো।
সুপারিশপত্র যেমন হওয়া চাই
বিভিন্ন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাবিষয়ক ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থীই প্রচলিত এবং একই ধাঁচের সুপারিশপত্র ব্যবহার করে আবেদনপত্রের সঙ্গে। এসব সুপারিশপত্রের বক্তব্যের ধরন প্রায় একই রকম। অর্থাৎ শিক্ষক অভিন্ন নমুনায় নাম পরিবর্তন করে একাধিক শিক্ষার্থীকে সুপারিশপত্র দিয়েছেন। এর ফলে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে আবেদনকারীরা গ্রহণযোগ্যতা হারায়। যোগ্য প্রার্থীর আবেদনও নাকচ হতে পারে এমন কারণে।
গবেষণার ধাপ
নিউজিল্যান্ডের দি ইউনিভার্সিটি অব অকল্যান্ডের পিএইচডি ভর্তি নির্দেশিকা থেকে জানা যায়, ভর্তির পর সাতটি ধাপে গবেষণা সম্পন্ন করতে হয়। এর প্রথম ধাপে গবেষণার ধরনসহ শিক্ষার্থীর নাম, টপিকস এবং আনুষঙ্গিক তথ্য নিবন্ধন করা হয়। শিক্ষার্থী কি পার্টটাইম নাকি ফুলটাইম গবেষণা করবে, তাও উল্লেখ থাকবে নিবন্ধনে।
দ্বিতীয় ধাপে নিবন্ধনে উল্লেখ করা তথ্য পর্যালোচনা করবে গবেষণাসংশ্লিষ্ট কমিটি। তৃতীয় ধাপে প্রথম শিক্ষাবর্ষের ফি জমা দিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বুঝে নিতে হবে। শিক্ষার্থী যদি নিবন্ধনে উলি্লখিত কোনো তথ্য কিংবা শর্ত পরিবর্তন করতে চায়, সে ক্ষেত্রে আবেদনের সুযোগ পাবে চতুর্থ ধাপে। বিভাগীয় প্রধান বরাবর আবেদন জানিয়ে বাড়তি সুবিধার আবেদনও করা যাবে এই ধাপে। পঞ্চম ধাপে গবেষণাপত্র জমা দিতে হবে। এর পরের ধাপটিতে পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। ফ্যাকাল্টির প্রধান, সহযোগী ডিন কিংবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিভাগীয় প্রধান পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করেন। কর্তৃপক্ষের মূল্যায়ন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কোনো আপত্তি বা ভিন্নমত থাকলে আপিলের সুযোগ পাবে শেষ ধাপে।
বিদেশি প্রকল্পের অধীনে গবেষণা
দেশে থেকেও বিদেশি অর্থায়নে গবেষণার সুযোগ আছে। তবে তা সীমিত পর্যায়ে। বিদেশি সরকার ও সংস্থা পরিচালিত অনেক প্রকল্পের আওতায় কিছু টপিকসের ওপর গবেষণা হয়; বিশেষ করে জীববৈচিত্র্য, ব্যাকটেরিয়া, স্বাস্থ্য, ভূমিকম্প ইত্যাদি বিষয়ে বিদেশি অর্থায়নে গবেষণা করতে পারবে নির্বাচিত শিক্ষার্থীরা।
খরচ কেমন
বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণার ধরনভেদে খরচ ভিন্ন। তবে মেধাবীদের ক্ষেত্রে মূল্যায়ন একটু বেশিই। কারণ গবেষণার সময় দায়িত্বে থাকা শিক্ষকের সহকারী হিসেবে কাজের সুযোগ মেধাবীদের ভাগ্যেই জোটে বেশির ভাগ সময়। গবেষণা সহকারীদের নির্দিষ্ট অঙ্কের ভাতা দেওয়া হয়। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কমবেশি সব শিক্ষার্থীই ফান্ড পাচ্ছে।
সূত্র: কালের কন্ঠ ।। সিলেবাসে নেই ।। তারিখ: ৭-৯-২০১১
[ কালের কণ্ঠতে এই লেখাটি ‘সীমানা পেরিয়ে গবেষণা‘ শিরোনামে প্রকাশ হয়েছিল ]
>> ইউটিউব চ্যানেলটিও সাবস্ক্রাইব করে রাখুন : youtube.com/edudaily24