৯ম-১০ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য এই প্রবন্ধ রচনাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রবন্ধ রচনা মূলত কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর লেখকের নিজস্ব চিন্তা, মতামত ও যুক্তিনির্ভর একটি রচনা। এই রচনায় অবশ্যই ভূমিকা, মূল অংশ ও উপসংহার থাকতে হবে। এছাড়া প্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তুও থাকে।
প্রবন্ধ রচনার মূল বৈশিষ্ট্য
১ . একটি নির্দিষ্ট বিষয়: প্রবন্ধ একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখা হয়।
২. যুক্তিনির্ভরতা: প্রবন্ধে লেখকের নিজস্ব মতামত ও যুক্তির উপস্থাপন করা হয়।
৩. বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা: বিষয়বস্তুকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা হয়।
৪. সুসংবদ্ধতা: প্রবন্ধের ভাষা ও গঠনশৈলী সুসংবদ্ধ ও সুস্পষ্ট হওয়া উচিত।
৫. ভূমিকা, মূল অংশ ও উপসংহার: একটি আদর্শ প্রবন্ধে এই তিনটি অংশ থাকা আবশ্যক।
রচনা : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি – বিজ্ঞানের অবদান
ভূমিকা: আধুনিক সভ্যতা বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। মানব ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, যে জাতি বিজ্ঞানে যত উন্নত, সে জাতি তত বেশি সভ্য ও শক্তিশালী। বিজ্ঞান শব্দের অর্থ হলো বিশেষ জ্ঞান, যা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত সুশৃঙ্খল জ্ঞানকে বোঝায়। আর এই বিজ্ঞানের व्यावहारिक প্রয়োগই হলো প্রযুক্তি। বিজ্ঞান যেখানে প্রকৃতির নিয়মাবলিকে উন্মোচন করে, প্রযুক্তি সেখানে সেই নিয়মকে কাজে লাগিয়ে মানব কল্যাণে নতুন নতুন যন্ত্র ও কৌশল উদ্ভাবন করে। বর্তমান যুগকে তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ বলা হয়। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র—শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, যোগাযোগ, বিনোদন—আজ বিজ্ঞানের অবদানে সমৃদ্ধ ও সহজতর হয়েছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান:
শিক্ষার প্রসারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। প্রাচীনকালের হাতে লেখা পুঁথি থেকে আজকের ডিজিটাল ক্লাসরুম পর্যন্ত এই যাত্রার পুরোটাই বিজ্ঞানের অবদান। ছাপাখানার আবিষ্কার জ্ঞানকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। বই, খাতা, কলম থেকে শুরু করে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর—সবই বিজ্ঞানের দান। আজ ঘরে বসেই বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাইব্রেরিতে প্রবেশ করা সম্ভব, অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে ডিগ্রি অর্জন করা যায়। ই-বুক, অডিওবুক, শিক্ষামূলক অ্যাপস এবং বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম শিক্ষাকে আরও আকর্ষণীয় ও সহজলভ্য করে তুলেছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারীর সময় অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখা সম্ভব হয়েছে কেবল প্রযুক্তির কল্যাণে। বিজ্ঞান শিক্ষাকে শ্রেণিকক্ষের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিয়ে এক বিশ্বজনীন রূপ দিয়েছে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান :
“Health is wealth” বা “স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল”—এই প্রবাদটির বাস্তব রূপায়ণে বিজ্ঞানের ভূমিকা অপরিহার্য। একসময় কলেরা, বসন্ত, প্লেগের মতো মহামারীতে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। মানুষ অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারত না। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে বিভিন্ন রোগের ভ্যাকসিন ও প্রতিষেধক। আজ বসন্ত ও পোলিওর মতো রোগ পৃথিবী থেকে প্রায় নির্মূল। অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান এনেছে অভাবনীয় সাফল্য। এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি, সিটি স্ক্যান, এমআরআই-এর মতো প্রযুক্তির মাধ্যমে শরীরের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নিখুঁত ছবি দেখে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, স্টেম সেল থেরাপি, অঙ্গ প্রতিস্থাপন এবং রোবটিক সার্জারির মতো উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি মানুষের গড় আয়ু বাড়াতে সাহায্য করেছে। বিজ্ঞানের কল্যাণে আজ মানুষ অনেক জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধির বিরুদ্ধে সফলভাবে লড়াই করতে সক্ষম।
কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান:
জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিজ্ঞান আমাদের প্রধান হাতিয়ার। সনাতন পদ্ধতির চাষাবাদে যেখানে উৎপাদন ছিল সীমিত, সেখানে আধুনিক বিজ্ঞান এনেছে ‘সবুজ বিপ্লব’। উচ্চ ফলনশীল (উফশী) বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং আধুনিক সেচ ব্যবস্থা খাদ্য উৎপাদন বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, হারভেস্টার ইত্যাদি আধুনিক যন্ত্রপাতি কৃষিকাজকে অনেক সহজ ও দ্রুততর করেছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে, যা খরা, লবণাক্ততা ও রোগ প্রতিরোধী। টিস্যু কালচারের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে অল্প সময়ে উন্নত মানের চারা উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। এক কথায়, বিজ্ঞানই আজ কোটি কোটি মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিজ্ঞানের অবদান:
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যোগাযোগ ব্যবস্থায় এনেছে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। প্রাচীনকালে যেখানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে খবর পাঠাতে ঘোড়া বা পায়রার উপর নির্ভর করতে হতো, সেখানে আজ মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, রেডিও, টেলিভিশন থেকে শুরু করে আজকের মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট—এই সবই বিজ্ঞানের অবদান। ইন্টারনেটের আবিষ্কার গোটা বিশ্বকে একটি ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বা ‘বৈশ্বিক গ্রামে’ পরিণত করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ই-মেইল, ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে আমরা ভৌগোলিক দূরত্বকে জয় করেছি। সড়ক, রেল, নৌ এবং আকাশপথে দ্রুতগামী যানবাহন চলাচল ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে, যা ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে সহজতর করেছে।
দৈনন্দিন জীবনে ও বিনোদনে বিজ্ঞান:
আমাদের ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্বারা প্রভাবিত। বৈদ্যুতিক বাতি, পাখা, এয়ার কন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন—এই সবকিছু আমাদের জীবনকে আরামদায়ক করেছে। আমরা যে পোশাক পরি, যে বাড়িতে বাস করি, তার নির্মাণেও রয়েছে বিজ্ঞানের ছোঁয়া। বিনোদনের জগতেও বিজ্ঞানের অবদান অসামান্য। সিনেমা, টেলিভিশন, কম্পিউটার গেমস, স্মার্টফোনের বিভিন্ন অ্যাপস আমাদের অবসরের সঙ্গী। বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা ঘরে বসেই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের খেলাধুলা, সঙ্গীত বা চলচ্চিত্র উপভোগ করতে পারি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপব্যবহার:
বিজ্ঞানের প্রতিটি আবিষ্কারের মতোই এরও একটি নেতিবাচক দিক রয়েছে। বিজ্ঞান মানবজাতির জন্য যেমন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে, তেমনই এর অপব্যবহার অভিশাপও ডেকে আনতে পারে। পারমাণবিক বোমার মতো মারণাস্ত্রের আবিষ্কার পৃথিবীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েছে। শিল্প কারখানার বর্জ্য পরিবেশকে দূষিত করছে, যার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মতো ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। প্রযুক্তির প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সাইবার ক্রাইম, অনলাইন প্রতারণা, ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহারের মতো ঘটনাগুলো প্রযুক্তির অন্ধকার দিককে তুলে ধরে।
উপসংহার:
বিজ্ঞান নিঃসন্দেহে মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ। এটি আমাদের অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোতে নিয়ে এসেছে, আমাদের জীবনযাত্রাকে করেছে সহজ, সুন্দর ও গতিময়। তবে মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞানের ভালো-মন্দ নির্ভর করে তার ব্যবহারকারীর উপর। আমরা যদি বিজ্ঞানকে মানব কল্যাণে ব্যবহার করি, তবে এটি পৃথিবীকে স্বর্গে পরিণত করতে পারে। আর যদি এর অপব্যবহার করি, তবে তা ডেকে আনবে মানবজাতির ধ্বংস। তাই আমাদের উচিত বিজ্ঞানের জ্ঞানকে विवेक ও বিচক্ষণতার সাথে মানবজাতির সার্বিক মঙ্গলের জন্য ব্যবহার করা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রাকে সঠিক পথে পরিচালনা করার মাধ্যমেই আমরা একটি সুন্দর ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপহার দিতে পারি।