হাতিরপুল, ঢাকা—এক নামের আড়ালে ঢাকা শহরের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। আজ যাকে আমরা ব্যস্ত বাজার আর জনাকীর্ণ এলাকার নামেই চিনি, সেই হাতিরপুল আসলে একসময় ঢাকার হাতি চলাচলের কেন্দ্র ছিল।
Table of Contents
কেন নাম হলো হাতিরপুল?
ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে এখানে তৈরি হয়েছিল একটি রেললাইন ও তার উপর একটি উঁচু পুল। পিলখানার হাতিগুলোকে গোসলের জন্য হাতিরঝিলে নিয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু হাতিরা নুড়িপাথর আর স্লিপারের উপর দিয়ে হাঁটতে পারতো না। তাই তাদের জন্য বানানো হয় বিশেষ সেতু বা পুল। আর সেখান থেকেই জায়গাটির নাম হয় হাতিরপুল।
পিলখানা ও এলিফ্যান্ট রোডের ইতিহাস
“পিল” মানে হাতি, আর “খানা” মানে আশ্রয়। সরকারি মালিকানাধীন অসংখ্য হাতি থাকতো পিলখানায়। সেখান থেকে রমনা পার্কে চারণভূমির জন্য হাতিদের আনা-নেওয়া হতো হাতিরপুল হয়ে। সেই রাস্তাটিই পরিচিত ছিল এলিফ্যান্ট রোড নামে।
আজকের ইস্টার্ন প্লাজা থেকে শাহবাগ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা একসময় ছিল বনভূমি। হাতি চলাচলের জন্য গাছ কেটে তৈরি করা হয় রাস্তা, যেখান দিয়ে মাহুতরা শত শত হাতি নিয়ে যেতেন। পরবর্তীতে “নিউ এলিফ্যান্ট রোড” নামের আড়ালে আদি ইতিহাস হারিয়ে যায়।
হাতিরপুল বাজারের গোড়াপত্তন
১৯৫০-এর দশকে পুলের আশেপাশে ছোটখাটো দোকান বসতে শুরু করে। নতুন বাসিন্দাদের চাহিদা মেটাতে অস্থায়ী দোকানই একসময় বাজারে রূপ নেয়।
তৎকালীন সময়ে রিকশা নিয়ে পুল পার হতে চাইলে স্থানীয় ছেলেদের ২-৩ আনা দিতে হতো, যারা দলবেঁধে রিকশা ঠেলে পুল পার করে দিতো।
গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি
হাতিরপুলের পথেই ছিল শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর বাড়ি – “দারুল আফিয়া।” এখান থেকেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে নিয়ে যায়।
আবার শোনা যায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি সেনারা এই পুলের উপর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে গুলি ছুঁড়েছিল।
নগর পরিকল্পনা ও হারিয়ে যাওয়া খাল
রমনা এলাকার চারপাশে বহু খাল ছিল, যেগুলো হাতি পারাপারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আজ সেগুলো মানচিত্রে থাকলেও বাস্তবে হারিয়ে গেছে দখল আর ভরাটের কারণে। অথচ হাতিরঝিলের মতো পরিকল্পনা করলে এগুলোও ঢাকার যানজট ও সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারতো।
শেষ বিদায়
১৯৭০-এর দশকে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়—৫০ বছরের পুরোনো এই হাতিরপুল ভেঙে নতুন রাস্তা তৈরি করা হবে। নগর পরিকল্পনাবিদরা তখন বলেছিলেন, কমলাপুরে নতুন স্টেশন হওয়ার পর এ পুলের আর প্রয়োজন নেই।
আজ হাতিরপুল শুধু একটি জনবহুল বাজার ও স্মৃতির নাম, অথচ এর ভেতরে লুকিয়ে আছে ঢাকা শহরের ২০০ বছরের ইতিহাস।
1. ব্রিটিশরা ঢাকায় হাতি ব্যবহার করতো শুধু পরিবহনেই নয়, বরং শোভাযাত্রা ও সামরিক শক্তির প্রতীক হিসেবেও।
2. মোগল আমলে হাতি ছিল রাজকীয় বাহন—ঢাকার কোর্ট-কারখানা, শিকারে, যুদ্ধের ময়দানেও ব্যবহৃত হতো।
3. “হাতিরপুল” নামটি ঢাকা শহরের পুরোনো নামগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা আজও টিকে আছে—যদিও সেই হাতি আর পুল নেই।
হাতিরপুলের হাতিদের যাতায়াত পথ
ঢাকার ইতিহাসে হাতিরপুল শুধু একটি জায়গার নাম নয়, বরং হাতি চলাচলের স্মৃতি বহন করে।
- হাতিগুলো আসতো পিলখানা থেকে – যেখানে সরকারি হাতিদের আশ্রয় ছিল।
- সেখান থেকে তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ পুল, যার নাম থেকেই জায়গার নাম হয় হাতিরপুল।
- এই পুল পার হয়ে হাতিগুলো যেত হাতিরঝিল–এ গোসল করাতে, আর কখনো রমনা পার্কে চারণভূমিতে।
আজ হাতি আর পুল নেই, কিন্তু নামের ভেতর লুকিয়ে আছে ঢাকার রাজকীয় দিনের গল্প।
হাতিরপুল আজ শুধু একটি ব্যস্ত বাজার আর এলাকার নাম হলেও, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে ঢাকার হাতি চলাচলের রাজকীয় ইতিহাস। একসময় এই পথ দিয়েই পিলখানা থেকে হাতিরঝিল ও রমনায় যেতো হাতির পাল। সেই স্মৃতি এখন কেবল ইতিহাস আর পুরোনো ছবির পাতায় বেঁচে আছে।
লেখা-মোঃনাঈম ভুইয়া
এডমিন-ঢাকার গণপরিবহন