এ এইচ সবুজ, গাজীপুর: 'ঘোড়াতে চড়িয়া মর্দ হাটিয়া চলিল, কিছুদূর যাইয়া মর্দ রওনা হইলো' পুরনো দিনের সেই রূপকথার বাস্তবতা যেন গাজীপুরের কাপাসিয়া ও নরসিংদীর মনোহরদী ও শিবপুরের বাসিন্দারা উপলব্দি করতে পারছেন।
কাপাসিয়ায় শীতলক্ষ্যা নদীর উপর রাণীগঞ্জ-বটতলা সেতু নির্মাণের প্রায় সাড়ে ৬ বছর পর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা ও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে নদীর মাঝখানে পাইলিং করতে না পেরে তারা পাইলিংয়ের গভীরতা ৫শত মি.মি কমানোর আবেদন করেছেন।
আগামী জানুয়ারি মাসে নির্মাণাধীন এই সেতুর কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এরই মাঝে সেই আবেদন মঞ্জুর হলে, তারা নতুন করে সময়ের আবেদন করে পুরো উদ্যমে কাজ শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প ব্যবস্থাপক। অথচ একই সাথে টেন্ডার হওয়া সারা দেশের কাছাকাছি দৈর্ঘের অন্যান্য সেতুগুলোর উপর দিয়ে প্রায় তিন বছর ধরে জন সাধারণ ও যানবাহন চলাচল করছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি,অদক্ষতা ও নানা সীমাবদ্ধতা আর স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা ও যথাযথ তদারকির অভাবে গাজীপুরের কাপাসিয়ার শীতলক্ষ্যা নদীর উপর নির্মাণাধীন রাণীগঞ্জ-বটতলা সেতুটির নির্মাণ কাজ এগুচ্ছে কচ্ছপ গতিতে। প্রায় সাড়ে ৬ বছর পর দুই দফায় দুইজন ঠিকাদারের কাজের যোগফলে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ।
প্রথম দফায় নির্ধারিত তিন বছর মেয়াদে ১৫ শতাংশের বেশি কাজ শেষ করতে না পারায় এবং নানা অনিয়ম ও ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান 'নাভানা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড'কে মোটা অংকের জরিমানা করে চুক্তি ও কার্যাদেশ বাতিল করে স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তর।
পরে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে নতুন করে 'কনফিডেন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড'কে কার্যাদেশ দিয়ে ২০২৬ সালের ১৮ জানুয়ারির মাঝে তা সম্পন্নের নির্দেশ দিলেও এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে সেতুটির ৩০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয় নি। অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ, ব্যস্ততম ও জনবহুল এলাকার এ সেতুটির নির্মাণ কাজ দীর্ঘ দিন ধরে ঝুলে থাকায় এলাকার সাধারণ মানুষের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
রাজধানী ঢাকা,গাজীপুর, নরসিংদীর মনোহরদী ও শিবপুর এবং সিলেট অঞ্চলে সহজে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের সুবিধার্থে কাপাসিয়ার রাণীগঞ্জ বাজার এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদী ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের সংযোগস্থলে একটি সেতু নির্মাণের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল দুই তীরের বাসিন্দাদের। ওই নদী দ্বারা বিভক্ত কাপাসিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের মানুষ এবং নরসিংদীর মনোহরদী ও শিবপুর উপজেলার লোকজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী মো: খলিলুর রহমান এখানে একটি সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের পল্লী সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধানে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর ২০১৯ সালের ২২ মে সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ৫৮৪ মিটার দৈর্ঘের সেতুটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা। নির্মাণকারী সংস্থা 'নাভানা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড' প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত ৩ কোটি ২৩ লাখ ৬৯ হাজার ৭৩৬ টাকা বেশি ব্যয়ে কার্যাদেশ পায়। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিমূল্য ৬৮ কোটি ৩৬ লাখ ৬৯ হাজার ৭৩৬ টাকা। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের ২২ মে।
সেতু নির্মাণের নির্ধারিত তিন বছর সময়ে মাত্র ১৫ শতাংশের বেশি কাজ শেষ করতে না পারায় এবং নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান 'নাভানা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড' কে ছয় কোটি টাকা জরিমানা করে তাদের সাথে চুক্তি বাতিল করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।
পরবর্তী সময়ে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করে প্রায় ৭২ কোটি টাকা চুক্তিমূল্যে 'কনফিডেন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড' কে কার্যাদেশ দেয়। তারা ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি নতুন করে কাজ শুরু করে এবং তাদেরকে এ সেতুটি ২০২৬ সালের ১৮ জানুয়ারির মধ্যে শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু তাদেরও দক্ষ এবং পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব, সাব কন্ট্রাকটরদের সময়মতো বিল পরিশোধ করতে না পারায় বারবার সাব কন্ট্রাকটর পরিবর্তন হওয়া ও সহায়ক ভারী যন্ত্রপাতির অভাবে (যেমন পাইলিং করার জন্য নিজস্ব সহায়ক ভার্জ না থাকা, কারিগরি নিয়ম অনুযায়ী স্পেনের নির্ধারিত দৈর্ঘ্য অনুযায়ী সাটারিং এর নিজস্ব মালামাল না থাকায়) কচ্ছপ গতিতে থেমে থেমে কাজ চলমান রয়েছে।
এমনকি গত কয়েকদিন আগে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে ও অদক্ষ একজন শ্রমিককে দিয়ে সাটারিংয়ের ইলেক্ট্রিক ওয়েল্ডিং চলাকালে নওগাঁ জেলার মান্দা থানার একজন শ্রমিক বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছেন।
শনিবার সরেজমিন সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এ পর্যন্ত নদীর পশ্চিম প্রান্তে কয়েকটি স্প্যান স্থাপনের পর তিনটি স্পেনের উপর ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে এবং পূর্ব পাশে দুটি স্প্যান স্থাপন করা হয়েছে। প্রায় এক বছর ধরে আরেকটি স্পেনের উপর ছাদ ঢালাইয়ের জন্য বাইন্ডিং করা রডের খাচায় মরিচার আস্তর পরে রয়েছে। সেতুর পশ্চিম প্রান্তের এই স্পেনের নিচেই ৭-৮ জন লোক ছাদ ঢালাইয়ের জন্য সাটারিংয়ের কাজ করছেন। একটু পশ্চিম পাশেই টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা একটি স্থানে প্রায় তিন বছর আগে চীন থেকে আমদানি করা ৪০-৫০ টন রড খোলা আকাশের নিচে কর্দমাক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। আর বৃষ্টির পানিতে ভিজে মরিচা ধরে রডের গুণমান অবচয় হওয়া এসব রড দিয়েই প্রয়োজনীয় সব রড বাইন্ডিংয়ের কাজ চালানো হচ্ছে। নদীর তীরবর্তী স্থানে প্রায় দুই বছর আগে বাইন্ডিং করা বেশ কয়েকটি মরিচা পড়া রডের খাচায় আশপাশের গাছ পালা ও লতাপাতায় আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে রয়েছে।
কাজের এমন ধীরগতির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পের ম্যানেজার মো.ওয়াহিদুল ইসলাম জানান, এ পর্যন্ত এই সেতুর ৩০-৩৫ শতাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। নদীর মাঝখানে একটি পিলারের জন্য ১ হাজার ৫শত মি.মি গভীরতার দুটি পাইলিং করতে গিয়ে দুই দফায় মাটি ধ্বসে যাওয়ার কারণে খাঁচা নামানো এবং ঢালাই করা সম্ভব হয়নি। তাই এখনো পর্যন্ত নদীর মাঝখানের ২৪টি পাইলিংয়ের কাজ তারা শুরু করতে পারছেন না।
এলজিইডি'র উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তারা নতুন করে ডিজাইন পরিবর্তন করে ১ হাজার মি.মি. পাইলিংয়ের অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছেন। সেই অনুমোদন পেলে তারা পাইলিংয়ের কাজ শুরু করবেন। তাছাড়া ৪ টি স্পেনের উপরে একসাথে ছাদ ঢালাই সরঞ্জাম না থাকায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই একটি করে স্পেনের ছাদ ঢালাই করছেন বলে তিনি দাবি করেন।
কাজের তদারকি কর্মকর্তা কাপাসিয়া উপজেলা প্রকৌশলী মো: বেলাল হোসাইন জানান, এ সেতুর জন্য নদীর মাঝখানে দুটি পাইলিংয়ে মাটি দুই দফায় ধ্বসের কারণে পাইলিং করতে না পেরে নতুন করে মাটি পরীক্ষার রিপোর্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। এখন যদি পাইলিংয়ের গভীরতা কমে যায় তবে স্পেনের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে নতুনভাবে ডিজাইন হবে। সেই অনুযায়ী আগামী নভেম্বর মাস থেকে নদীর মাঝখানের ২৪টি পাইলিংয়ের কাজ শুরু করতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি।
তিনি আরো জানান, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হলে এবং এর মাঝে যেকোন অনিয়ম ধরা পড়লে বর্তমান ঠিকাদারকেও নিয়ম অনুযায়ী জরিমানা করা হবে।