কোরবানির পশু জবাই করার নিয়ম, পদ্ধতি ও দোয়া
কোরবানির পশু জবাই কিভাবে জবাই করতে হয়, এটা নিয়ে অনেকেরই জানার আগ্রহ। কোরবানির পশু অর্থাৎ গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, উট ইত্যাদি জবাই নিয়ে অনেকগুলো ভুল-ভ্রান্তি আমাদের মধ্যে রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা যখন জবাই করবে, তখন ইহসানের (আসানির) সাথে জবাই করো, আর তোমাদের ছুরিগুলো খুব ভালোভাবে ধারালো করে না-ও, যাতে তোমরা তোমাদের জবাইকৃত পশুকে আরাম দিতে পারো।’ (সহিহ মুসলিম)
কোরবানির পশু জবাই করার নিয়ম বা পদ্ধতি
- ১. পশু জবেহ করার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলে জবেহ করা শুরু করতে হবে। বিসমিল্লাহ বলেই ছুরি চালানো শুরু করতে হবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যেন পশু জবেহ করা না।
- ২. পশু জবেহ করার সময় কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, পশুর খাদ্যনালী, শ্বাসনালী আর দুই পাশে থাকা দুটি নালী কেটে দেয়া। এ নালীগুলে কাটা হয়ে গেলেই পশু জবেহ বিশুদ্ধ হয়ে যায়।
- ৩. পশু জবেহ করার জন্য ছুরি ভালোভাবে ধার দিয়ে নিতে হবে। যাতে জবেহ করার সময় পশুর কষ্ট না হয়। অনেকে একটি ছুরি দিয়ে একাধিক পশু কুরবানি করে থাকেন। সেক্ষেত্রে শেষ দিকে ছুরির ধার কমে যায়। তাই ছুরিতে ধার দিয়ে নেওয়া উত্তম। হাদিসে এসেছে-
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পশু জবেহ করার আগে ছুরি-চাকুতে ভালোভাবে ধার দিয়ে নেয়া।’ (মুসলিম) - ৪. একটি পশুর সামনে অন্য পশুর জবেহ না করা। পশুর সামনে ছুরি-চাকুতে ধার না দেওয়া। এতে পশু ভয় পেয়ে যায়। এটি পশুকে কষ্ট দেওয়ারও শামিল।
পশু কোরবানির সময় লক্ষ্যণীয় বিষয়
- ১. কুরবানি করার সময় পশুকে পশুর বাম কাতে শোয়ানো হবে। যেন উক্ত সময় পশুর পাগুলো পশ্চিম দিকে থাকে। এতে করে চুরি চালানোর সময় পশু তার গলা দেখতে না পায়।
- ২. গরু বা বড় পশুর ক্ষেত্রে আগে ভালো ভাবে পা বেঁধে নেওয়া, যাতে করে জবাই করার সময় নড়াচড়া করতে না পারে।
- ৩. সাধারণত ৩ বার চুরি চালানোর মধ্যে দিয়ে কোরবানির পশু জবাই করা হয়ে থাকে, তবে ক্ষেত্র বিশেষ আর বেশিবার চুরি চালানো যাবে।
- ৪. পশু জবাই শেষে, যখন একদম নিস্তেজ হয়ে পরবে অর্থাৎ জীবন চলে যাবে তারপর চামড়া ছাড়াতে হবে। ধারালো চুরি দ্বারা প্রথমেই পায়ের নলী কেটে দিতে হবে।
কোরবানির পশু শোয়ানোর পর যেন কিবলামুখী হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পশ্চিম দিকে যেহেতু আমাদের কিবলা সেই হিসেবে পশ্চিম দিকে যাতে পশুর মুখ হয় সেদিকে আমরা খেয়াল রাখব। অর্থাৎ, পশুকে বাঁ-পাজরের ওপর, দক্ষিণ দিকে মাথা দিয়ে কিবলামুখী করে শোয়াতে হবে। এভাবেই পশুকে শোয়ানো উত্তম। পশুটিকে এমনভাবে ধরতে বা বেঁধে নিতে হবে যেন জবাইয়ের সময় সে পাগুলো বারবার ছুড়তে না পারে।
উটের ক্ষেত্রে নাহর করা যায়। বিষয়টি হলো দাঁড়ানো অবস্থায় বুকের দিক থেকে ঘাড় পর্যন্ত চলে যাওয়া প্রধান রক্তবাহী রগ কেটে দেয়া হয়। নাহর করলে রক্তক্ষরণ হতে হতে উট নিস্তেজ হয়ে মাটিতে ঢলে পড়ে এবং মৃত্যু হয়। উটকেও শোয়া অবস্থায় জবাই করা যায়।
জবাই করার সময় যাতে পশু কষ্ট না পায়, সে জন্য যে ছুরিটি ব্যবহার করা হবে, তা আগেভাগেই শান দিয়ে খুব ধারালো করে নিতে হবে। পশুর গলায় ছুরি চালানোর সময় ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলতে হবে। শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ বললেও চলবে। যে বা যারা কোরবানির পশু জবাই করবেন বা ধরবেন, তারা পবিত্র বা অজু অবস্থায় থাকবেন। কাপড়-চোপড় শালীনভাবে পরিধান করবেন।
পশুকে শোয়াতে কষ্ট হলে বা বেগ পেতে হলে শোয়ানোর পর রেগে গিয়ে পশুর শরীরে কিল, ঘুষি, লাথি মারা বা আঘাত করা যাবে না। যিনি বা যার পক্ষ থেকে কোরবানি দেয়া হচ্ছে, তার নিজের হাতে জবাই করা উত্তম। অবশ্য অংশীদারত্বের মাধ্যমে কোরবানি করলে যেকোনো শরিক ব্যক্তি জবাই করতে পারেন। অভ্যাস না থাকলে অন্য যে কেউ জবাই করলেও হবে।
ছুরি ডান হাতে অথবা উভয় হাতে ধরা ভালো। কোনোক্রমেই শুধু বাঁহাত ব্যবহার করে জবাই করা উচিত নয়। ছুরি চালানোর সময় পশুর গলার মূল তিনটি অঙ্গ কেটে দিতে হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে খাদ্যনালি, দ্বিতীয়টি শ্বাসনালি, তৃতীয়টি হচ্ছে শ্বাসনালির দুই পাশে দুটি রগ রয়েছে সে দুটি। যদি ঠিকমতো এই অঙ্গগুলো কেটে দেয়া যায়, তাহলে গরু দশ থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যেই নিস্তেজ হয়ে পড়বে। এভাবে জবাই করা সুন্নত।
আমাদের দেশে অনেকেই গরু জবাই করতে গিয়ে ছুরি চালানোর পর ছুরির ধারালো বা সুচালো মাথা দিয়ে খোঁচাখুঁচি করেন, মেরুদণ্ডের সঙ্গে ঘাড় পর্যন্ত যে স্পাইনাল কর্ড রয়েছে, সেটির রগ কাটার জন্য চেষ্টা করেন। এ ধরনের খোঁচাখুঁচি কোনোক্রমেই উচিত নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, এভাবে খোঁচাখুঁচির ফলে পশুটি মৃত্যুর আগেই একবার হার্টফেল করে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উল্লিখিত হাদিসটির মাধ্যমে আমরা যা বুঝি তা হচ্ছে, পশুকে আরামের সঙ্গে জবাই করতে হবে, যাতে সে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় কসাই অথবা যারা গরুর গোশত বানানোর জন্য আসে, তারা পশু নড়াচড়া করা অবস্থায় পায়ের রগ কাটা শুরু করে দেয়। এটা করলে পশুকে সুন্নত পন্থায় জবাই করা হয় না। অনেক সময় এভাবে জবাই করাকে ‘জবাই করা বলে না’ বরং ‘হত্যা করা বলে’। আল্লাহ আমাদের জবাই করার নির্দেশ দিয়েছেন, হত্যা করতে নয়।
তাই আমরা যারা পশু কোরবানি করি, সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে, যাতে আমাদের কোরবানি সম্পূর্ণভাবে সঠিক হয় এবং এর জবাই প্রক্রিয়া রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দেখানো সুন্নতমতে হয়। আল্লাহ আমাদের জেনে-বুঝে নিয়মানুযায়ী কোরবানির পশু জবাই করার তাওফিক দিন। আমিন।
পশু জবাইয়ের দোয়া
কুরবানির পশু জবেহ করার জন্য শোয়ানোর পর দোয়া পড়া। দোয়াটি হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে। যদিও অনেকে দোয়াটির সনদের ব্যাপারে মতপার্থক্য করেছেন। তবে এ দোয়াগুলো পড়ে কুরবানি করা উত্তম। তবে কেউ শুধু বিসমিল্লাহ বলে নালীগুলো কেটে দিলেই কুরবানি শুদ্ধ হয়ে যাবে। দোয়াটি হলো-
اَللَّهُمَّ إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ عَلَى مِلَّةِ اِبْرَاهِيْمَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ – إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ – لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ – بِسْمِ اللهِ اَللهُ اِكِبَر – اَللَّهُمَّ مِنْكَ وَ لَكَ
উচ্চারণ- ইন্নি ওয়াঝঝাহতু ওয়াঝহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা আলা মিল্লাতি ইবরাহিমা হানিফাও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। লা শারিকা লাহু ওয়া বি-জালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা মিনকা ও লাকা।
২. যদি কেউ এ দোয়াটি না পারেন তবে ছোট্ট এ অংশটুকু পড়বেন-
بِسْمِ اللهِ اَللهُ اِكِبَر – اَللَّهُمَّ مِنْكَ وَ لَكَ
উচ্চারণ : বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা।
৩. নিজের পশু নিজে কুরবানি করলে পশু জবেহ করার পর এ দোয়া পড়া-
اَللهُمَّ تَقَبَّلْ لَهُ مِنِّى كَمَا تَقَبَّلْتَ مِنْ حَبِيْبِكَ مَحَمّدٍ وَّ خَلِيْلِكِ اِبْرَاهِيْم
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা তাকাব্বালহু মিন্নি কামা তাকাব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মাদিও ওয়া খালিলিকা ইবরাহিম।’
৪. অন্য কেউ কুরবানি বা অন্য কারো কুরবানি করলে এ দোয়া পড়া-
اَللهُمَّ تَقَبَّلْ لَهُ مِنِكَ-مِنْكُمْ كَمَا تَقَبَّلْتَ مِنْ حَبِيْبِكَ مَحَمّدٍ وَّ خَلِيْلِكِ اِبْرَاهِيْم
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা তাকাব্বালহু মিনকা-মিনকুম’ কামা তাকাব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মাদিও ওয়া খালিলিকা ইবরাহিম।’
উল্লেখ্য, যদি কেউ একাকি কুরবানি দেয় এবং নিজে জবাই করে তবে বলবে মিন্নি; আর অন্যের কুরবানির পশু জবাই করার সময় ‘মিনকা-মিনকুম’ বলে যারা কুরবানি আদায় করছে তাদের নাম বলা।