জেনে রাখুন

শের আলী আফ্রিদি : ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সত্যিকারের সিংহ

শের আলী আফ্রিদি [Sher Ali Afridi] – ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সত্যিকারের সিংহ : বিট্রিশবিরোধী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমগ্র ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বেনিয়াদের প্রায় ২০০ বছর শাসনে একজন মাত্র বড় লাটকে হত্যা করা সম্ভব হয়েছিল। ভাইসরয় পদবির মানে হচ্ছে ব্রিটেনের রাণির সরাসরি প্রতিনিধি। ব্রিটেনের রাণী ও প্রধানমন্ত্রীর পরে ভারতে নিয়োজিত ভাইসরয় হচ্ছেন তাদের প্রশাসনের তৃতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সেই বড় লাট লর্ড মেয়ো’কে হত্যাকারী উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একমাত্র শের’ বিপ্লবী শের আলী আফ্রিদি’র ইতিহাসকে কেন দাবিয়ে রাখা হয়েছে?

ছোটখাটো পুলিশ কর্মকর্তা, সেনা সদস্য, বেসামরিক ব্রিটিশ নাগরিক, ইংলিশ ক্লাবে আক্রমন, কোন প্রদেশের জেলার মহকুমার অধীন কোন ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা করা কোন কোন বিপ্লবীকে নিয়ে হাজারো গান, কবিতা, শহীদ বেদি, স্থানের নাম করা হলেও কেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি বড় লাটকে হত্যা করেছেন, সেই বাঘের বাচ্চাকে নিয়ে কোন আলোচনা কেন হয়না?

  • জন্ম স্থান ও পেশা : শের আলী আফ্রিদির জন্ম খায়বার এজেন্সির (বর্তমান পাকিস্তান, তৎকালীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া) তিরাহ গ্রামে। তিনি কলোনিয়াল সরকারের পাঞ্জাব পুলিশে চাকরি করেন। এছাড়া তিনি পেশোয়ারের কমিশনারের কার্যালয় ও কলোনিয়াল আর্মি ও প্রেসিডেন্সি আর্মিতে কর্মরত ছিলেন।
  • মৃত্যু : ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দিপপুঞ্জের ভাইপার দ্বীপে ১১ মার্চ ১৮৭২ তারিখে কারাবন্দী অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। এর আগে, ব্রিটিশ শাসিত ভারতের উচ্চপর্যায়ের একটি পদধারী (ভাইসরয় অব ইন্ডিয়া) কর্মকর্তা লর্ড মায়ো (Lord Mayo)-কে হত্যার জন্য শের আলী আফ্রিদিকে গ্রেপ্তার করে আন্দামান ও নিকোবর দিপপুঞ্জে কারাবাস দেয় ব্রিটিশ সরকার।

কে এই শের আলী আফ্রিদি

শের আলি আফ্রিদির আদি নিবাস পাকিস্তানের খাইবারপাস প্রদেশের নিকটবর্তি জামরুদ গ্রামে। পিতার নাম ঊলি আলি খান। ধারণা করা হয় তিনি ছিলেন কথিত ওয়াহাবী* আন্দোলনের সাথে যুক্ত।

প্রথম জীবনে তিনি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে মাউন্ট পুলিশে দক্ষতা ও সততার সাথে কাজ করেন। পরে কমিশনারের অধীনেও কাজ করেন।

১৮৬৭ সালে শীর্ষস্থানীয় ওয়াহাবী নেতা মৌলানা জাফর থানেশ্বরী সহ অন্যান্য বিপ্লবীকে ধরিয়ে দেওয়া ও পুলিশের গুপ্তচরবৃত্তির সন্দেহে হায়দার আলি নামক এক যুবককে হত্যা করেন শের আলি। এতে সাজা হিশেবে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হন তিনি।

অনেক ইতিহাস আবার এটাকে পারিবারিক কলহে হত্যাকাণ্ড বলে চালিয়েছেন। কেননা, ওয়াহাবী আন্দোলনের কারণে ফাঁসি হলে শহীদ হিশেবে তিনি আরো অনেকের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবেন।

যাইহোক, তাকে পেশোয়ার থেকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি প্রথম থেকেই নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ ও নিরপরাধ বলে দাবি করেন। পরে আপিলে তার সাজা কমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

তাকে নির্বাসন করা হয় আন্দামানে।। বলা জরুরী যে, ইতোমধ্যে যারা ব্রিটিশদের বিরোদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিল তাদেরকে আন্দামানে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল।

শের আলী আফ্রিদি ছিলেন বেশ ধার্মিক ও দয়ালু। জেলখানায়ও তার ব্যবহার ছিল অনন্য। সদা শান্ত-শিষ্টভাবে থাকতেন। তিনি নাপিতের কাজ করে যা আয় করতেন তা জেলে থাকা সহযোগীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। জেলে তিনি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। কিন্তু তার হৃদয়ে জ্বলছিল আগুন। নির্জন দ্বীপে শত শত বিপ্লবীদের নির্বাসন ও অত্যাচারের বদলা নেওয়ার কথা ভাবতে থাকেন তিনি।

অবশেষে সে সুযোগও চলে আসলো। ১৮৭২ সালের ০৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে লর্ড মেয়ো হ্যারিয়েট দ্বীপের সানসেট পয়েন্টে সূর্যাস্ত দেখতে যান।সেসময় দেহরক্ষী বেষ্টিত থাকলেও তাকে অতর্কিতে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন শের আলি।ভারতবর্ষের বৃট্রিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে শের আলি খান এমন এক ব্যক্তি যিনিই একমাত্র ভারতের গভর্নর জেনারেল কে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।তার এই হত্যা, বৃটেন তথা ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়।

ইতোমধ্যে শের আলী গ্রেফতার হন। বলা বাহুল্য যে, তিনি পালিয়ে যান নি। এবং বড় লাটের নিরাপত্তারক্ষীরাও কাছে ছিলেন। পরের দিন খুবই দ্রুততার সহিত বিচার কাজ শুরু হয়। আদালত তাকে জিজ্ঞাসা করে, লর্ড মেয়ো হত্যায় তার সাথে আর কেউ জড়িত আছে কিনা।

শের আলী বিশ্বাস করতেন স্বয়ং আল্লাহই তাকে বড় লাটকে হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আদালতের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খুদা নে হুকুম দিয়া। মেরা শরীক কোই আদমি নেহি। মেরা শরীক খুদা হ্যায়।’ অর্থাৎ আমাকে একাজ করার জন্য খোদা হুকুম দিয়েছেন। আমার শরীক অন্য কেউ নাই, আমার শরীক হচ্ছেন খোদা।

বিচারে শের আলির ফাঁসি হয়। ১৮৭৩ সালের ১১ মার্চ আন্দামানের ভাইপার দ্বীপে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। ফাঁসির দিন ফাঁসির দড়িকে চুমু খেয়ে সেই দড়ি পড়ে নেন এবং”লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু”এই কথা দুবার বলার পরই তাঁর শ্বাস রোধ হয়ে যায়।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অমর শহীদ ‘শের আলী আফ্রিদি’। বড়লাটকে হত্যা করে ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েও যিনি স্থান পান নি ইতিহাসের পাতায়!

কারন বড় লাটকে হত্যা করা শের আলী কোন আর্যরা ছিলনা, নাম ছিল আলী, তিনি ছিলেন একজন মুসলিম! মুসলিম বলেই তাকে কেউ চিনে না বা চিনতে দেওয়া হয়নি। দাবিয়ে রাখা হয়েছে ইতিহাস।

[সংগৃহীত]

5/5 - (3 votes)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page