প্রার্থী পাবলিক নাকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের, চাকরির নিয়োগের সময় সেটা দেখা হয় না

সৈয়দ আলমগীর, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস

১। বিবিএ, এমবিএ ডিগ্রিধারীদের চাকরির ক্ষেত্রে ফলাফলের পাশাপাশি অন্য কোন কোন বিষয় দেখেন?
—প্রথম কথা হলো, একজন শিক্ষার্থী বিবিএ যখন পড়ে তখন সে বিজনেসের প্রায় সব কোর্সই পড়ে। আমি নিজেও একজন এমবিএ ডিগ্রিধারী হওয়ায় ব্যাপারটা জানি। তাই এ বিষয়টি বেশি উপলব্ধি করতে পারি। আমি এমবিএতে ২০টি বিষয়ের মতো পড়েছিলাম। বিজনেসের জন্য বেশি দরকার এমন অনেক কোর্স এখানে করানো হয়; যেমন—অর্থনীতির কিন্তু তিনটি কোর্স থাকে—মাইক্রো ইকোনমিকস, ম্যাক্রো ইকোনমিকস ও ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস। বিজনেস বোঝার জন্য অর্থনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ; বিজনেসের পরিবেশ এবং আর্থিক অবস্থা খুব ভালোভাবে বোঝার জন্য। সেগুলো আবার কাগজে রূপান্তর করার জন্য ফিন্যান্স ও অ্যাকাউন্টিং লাগে। ফিন্যান্সের দু-তিনটি কোর্স করা লাগে। আবার কমিউনিকেশন বা যোগাযোগ লাগে, চিঠি লেখালেখি লাগে। সেটার জন্য একটা কোর্স আছে। তা হলো বিজনেস কমিউনিকেশন। অঙ্কের জন্য আছে স্ট্যাটিসটিকস বা পরিসংখ্যান। আবার দেখেন, আমরা কিন্তু লইয়ার না। কিন্তু কিছু আইন আমাদের জানতে হয়। এর জন্য একটি বিষয় আছে ‘বিজনেস ল’। এর মাধ্যমে জানা যায়, এলসি কী, লেটার অব ক্রেডিট কী। লেটার অব ক্রেডিট বিষয়ে কিন্তু অফিসে এসে কাজ করতে হয়। অনেক অফিস আছে, যেখানে অফিসে যোগদানের প্রথম দিন থেকে লেটার অব ক্রেডিট সামলাতে হচ্ছে। কাজেই আগে থেকে ধারণা থাকলে কাজ করতে সুবিধা হবে। একজন লোক, যার এ ব্যাপারে ধারণা নেই, তার কাছে বিজনেস ল বিষয়টি অচেনা মনে হবে। তাই এই সাবজেক্ট পড়ানো হয়। আবার ‘পারসোনাল ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি কোর্স পড়ানো হয়। কর্মীদের শৃঙ্খলার বিষয়ে কিভাবে পদক্ষেপ নেবেন, কিভাবে কিসের ভিত্তিতে কর্মীদের ছুটি দেবেন, টার্মিনেশন ও ডিসমিসাল কী, নিয়োগপত্র কী এবং কোনটি কেমন হওয়া উচিত, শ্রম আইন কী—এগুলোর স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় পারসোনাল ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে। আরেকটি হলো ‘মার্কেটিং’। মার্কেটিংয়ের ওপর অনেক কোর্স থাকে। মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট কী, প্রিন্সিপাল অব মার্কেটিং কী—এমন অনেক বিষয় দেওয়া থাকে, যা পরবর্তী কর্মজীবনে কাজে লাগে।
একটি উদাহরণ দিই : মার্কটিংয়ে চারটি ‘পি’ আছে। যেকোনো পণ্য বাজারে দেওয়ার সময় চারটি ‘পি’র কথা মনে রাখবেন। এগুলো হলো প্রডাক্ট, প্রাইস, প্লেস ও প্রমোশন। প্রাইসের মধ্যে কী আছে? এমআরপি আছে। ডিস্ট্রিবিউটরের জন্য দাম কত, দোকানদারের জন্য দাম কত—সব আছে এখানে। এ জন্য নরমাল গ্র্যাজুয়েটের চেয়ে বিজনেস গ্র্যাজুয়েট অনেক স্মার্ট হয়। তার অনেক কিছুতে বোঝাপড়া অনেক বেটার হয়।
আমি প্রথমেই বড় ম্যানেজারিয়াল পজিশনে জয়েন করেছিলাম একটা ব্রিটিশ ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানিতে। সেই কম্পানির এ ধরনের পোস্টে প্রমোশন পেতে মিনিমাম ১৬ বছর লাগে। অন্যরা তো পড়েছে কোন ওষুধ কী কাজে লাগে, ডাক্তার সাহেবকে বোঝানো লাগে কিভাবে। তারপর ওরা ম্যানেজারিয়াল পজিশনে এসেছে। কিন্তু আমি তো শুরুই করছি ম্যানেজারিয়াল পজিশনে। ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে আমি বিজনেস বুঝতে পারছি।

২। চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
—চাকরিপ্রার্থী পাবলিক নাকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সেটা দেখি না। দেখি চাকরিপ্রার্থীকে। এসিআই কম্পানি লিমিটেডে চাকরি পেতে গেলে একটা প্রক্রিয়া আছে। প্রথমে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা, দ্বিতীয়ত লিখিত পরীক্ষা, তারপর ভাইভা, আর সব শেষে প্রেজেন্টেশন। এসব শেষে তাদের ম্যানেজারিয়াল ডিরেক্টরের কাছে পাঠানো হয়। চাকরিপ্রার্থীর বক্তব্য, আচরণ ইত্যাদি দেখে ম্যানেজারিয়াল ডিরেক্টর নিয়োগ দেন। সাতজন থেকে বাছাই করে তিন থেকে পাঁচজন নিয়োগ দেওয়া হয়। এখানে চাকরিপ্রার্থী পাবলিক থেকে নাকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলো এটা কোনো বিষয় নয়। একটি খারাপ মানের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট বয়ও একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বেঞ্চের ছাত্র থেকে কোনো অংশে কম নয়। আমি তো দুটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম। দুটিতেই ভালো লেগেছে। কিছুদিন আগেও দু-তিনটিতে ক্লাস নিয়েছি।
চাকরিপ্রার্থী পাবলিক থেকে নাকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলো এটা কোনো বিষয় নয়। একটি খারাপ মানের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট বয়ও একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বেঞ্চের ছাত্র থেকে কোনো অংশে কম নয়। আমি তো দুটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম। দুটিতেই ভালো লেগেছে।

৩। এখন যদি বলি এই মুহূর্তে চাকরির বাজারটাকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন, বিশেষ করে বর্তমান সময়ে বিবিএ ডিগ্রিধারীদের চাহিদা বেড়েছে না কমেছে?
—প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। আপনাকে একটি কথা বলতে পারি, এখানে দাঁড়িয়ে (আমাদের) ভবনের চারপাশে যতজন দেখবেন সবাই মিনিমান বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রিধারী। এমনকি আমার সেক্রেটারিও বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রিধারী। এদের মধ্যে একজন ইংরেজিতে মাস্টার্স করা আছে। সেও কিন্তু এমবিএ ডিগ্রিধারী। এখানে কর্মীদের যা বলব, তারা ভালোভাবে বুঝবে। কারণ ওরা দক্ষ হয়ে গেছে। এটা একটা প্রতিষ্ঠানের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক দিক। আর এখন বিবিএ ডিগ্রিধারীরা আগের দিনের গ্র্যাজুয়েটদের ছাড়িয়ে গেছে।

৪। আনুপাতিক হারে বিবিএ ডিগ্রিধারীদের অবস্থান কোন পর্যায়ে আছে? অন্যান্য সাবজেক্ট থেকে এখানে চাকরি করতে অনেকে আসছে?
—না, আমার এখানে অন্যান্য সাবজেক্ট থেকেও আসছে। তবে হ্যাঁ, তারা এমবিএ করেছে। আমি নিজেও তো বিবিএ পড়িনি। ওই সময় বিবিএ ছিল না। আমি রসায়ন, পদার্থ, গণিত পড়েছি। তারপর আমি এমবিএ করেছি। আপনি যদি বলেন, বিবিএর সঙ্গে এমবিএ ভালো, নাকি অন্য ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে এমবিএ থাকলে ভালো? আমি বলব, অন্য ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসে এমবিএ করা বেশি ভালো।

৫। বিবিএ ডিগ্রিধারীরা নিজেদের ব্যাকগ্রাউন্ডের বাইরে অন্য কোনো সেক্টরে কি চাকরি পাচ্ছে?
—হ্যাঁ, অবশ্যই। আমার ব্যাচের অনেক বন্ধুই পুলিশে উচ্চপদে চাকরি করছে। ম্যাজিস্ট্রেটও আছে। বরং আইবিএ থেকে বিবিএ, এমবিএ করে কেউ বিসিএস ক্যাডার হতে চাইবে না। কারণ বেতন কম, প্রমোশন সহজে হয় না। আমি নিজেই বিসিএস পরীক্ষা দিইনি। আমি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দিন পড়িয়েছি। ঢাকায় এমন কোনো বড় বিশ্ববিদ্যালয় নেই, যেখানে আমি লেকচার দিইনি।

৬। ফিন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং, ব্যবস্থাপনা বিষয়গুলোকে মেজর হিসেবে নেওয়া শিক্ষার্থীদের আনুপাতিক হার কেমন?
—মার্কেটিংয়ের তুলনায় তাদের আনুপাতিক হার অনেক কম।
নরমাল গ্র্যাজুয়েটের চেয়ে বিজনেস গ্র্যাজুয়েট অনেক স্মার্ট হয়। তার অনেক কিছুতে বোঝাপড়া অনেক বেটার হয়।

৭। চাকরিপ্রার্থীর ক্ষেত্রে তাদের কোন মেজর বিষয়ের ওপর বিবিএ করাকে আপনারা বেশি প্রাধান্য দেন?
—আমাদের এখানে মার্কেটিংকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। কারণ প্রডাক্ট সেল হলে অর্থায়ন, পণ্য উত্পাদন, অন্য সব কিছু হবে।

৮। বিবিএ যারা পড়তে চায় এবং যারা পড়ছে তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
—আমার কথা হলো, তারা ভালো একটি বিষয় পছন্দ করুক। যখন এইচআরএম শুরু হলো, সবাই ভর্তি হওয়া শুরু করল। অথচ একটা প্রতিষ্ঠানে এইচআরএম বিভাগে বেশি কর্মীর তো দরকার হয় না। তাহলে কী বুঝে তারা এ বিষয়ে ঝুঁকছে? তাকে সর্বজনীন বিষয় মেজর হিসেবে নিতে হবে; যেমন—মার্কেটিং, ফিন্যান্স।

৯। আপনার মতে একজন বিবিএ বা এমবিএ ডিগ্রিধারী কিভাবে চাকরির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবে?
—চাকরির জন্য সব কিছুই পড়তে হবে—মার্কেটিং, ফিন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা (এইচআরএম) ইত্যাদি।

১০। এসিআই একটি ব্র্যান্ড আর আজকের আপনার এই সুনাম ও প্রতিষ্ঠার পেছনে কী আছে?
—প্রথমত, আল্লাহর রহমত না থাকলে এত দূর আসতে পারতাম না। দ্বিতীয়ত, পরিশ্রম ও অধ্যবসায়। অনেক কষ্ট করেছি। গ্রামে-গঞ্জে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি। এখনো ঘুরে বেড়াই। সব সময় মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করি।

১১। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আছেন এবং একটি প্রতিষ্ঠানের হেড হিসেবে আছেন। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসের সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল সিলেবাসের তুলনা দেবেন কি?
—আন্তর্জাতিক সিলেবাস বাংলাদেশে অনুসরণ করা হয়। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তাভাবনা করা উচিত। কোন কোন বিষয় বাংলাদেশে পড়ানো উচিত, কোন কোন বিষয় দরকার নেই, এগুলো বিবেচনা করা উচিত। একাডেমিক প্রফেশনাল সিস্টেম থাকা দরকার।

১২। বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর ছোট। পরিসর কি বাড়ানো দরকার?
—অবশ্যই পরিসর বাড়ানো দরকার। তারা কোর্স দেয়, যা দেড়-দুই মাসে শেষ করতে হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা দৌড়ের ওপর থাকে। তাদের কোর্সের জন্য সময় বাড়াতে হবে। তিন মাস হলে ভালো।

১৩। আপনি ইংরেজি শিক্ষাকে আপনার এই প্রতিষ্ঠানের জন্য কতটা গুরুত্ব দেন?
—অনেক বেশি গুরুত্ব দিই। ইংরেজি অবশ্যই জানতে হবে। ইংরেজি জানার বিকল্প নেই।

শ্রুতলিখন : রাকিবুল ইসলাম

সূত্র : কালের কন্ঠ । ৩০ অক্টোবর ২০১৯