খবর

সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ | শাস্তি কি, যা যা পরিবর্তন ও সংশোধন

বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (Digital security act) পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ (Cyber security act 2023) করেছে সরকার। ডিজিটাল আইনের অধিকাংশ ধারা নতুন আইনে থাকছে। তবে যেসব ধারা নিয়ে বেশি বিতর্ক ছিল; কয়েকটি ক্ষেত্রে সেগুলোর সাজা কমিয়ে আনা হয়েছে।

৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ সংক্রান্ত প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন এই আইনের খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবারও মন্ত্রিসভায় উঠবে। সব কাজ সেরে সংসদের আগামী সেপ্টেম্বরের অধিবেশনে নতুন আইন পাস করা হবে বলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এ জামিনের অযোগ্য কয়েকটি ধারাকে করা হয়েছে জামিনযোগ্য। নতুন আইনে বড় পরিবর্তন না আসায় সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের হয়রানি আদৌ থামবে কিনা– তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ডিজিটাল আইন ব্যবহৃত হচ্ছে বিরোধী মত দমনে ও মুক্ত মতপ্রকাশ বাধাগ্রস্ত করতে। প্রয়োজনীয় সংস্কার না করলে যে নামেই আসুক; হয়রানি কমবে না।

আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস হতে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সমালোচিত তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন বদলিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়েছিল সংসদে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) অপপ্রয়োগের কারণে জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা আইনটির যেসব ধারা বাতিল ও সংশোধনের দাবি করেছে, সেগুলো প্রায় সবই বহাল থাকছে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শুধু অজামিনযোগ্য আটটি ধারা জামিনযোগ্য করা ও শাস্তির মাত্রা কমানো হয়েছে। এর বাইরে সাইবার নিরাপত্তা আইনে খুব বেশি পরিবর্তন আসছে না। পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তারের বিধান, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষা, বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের নামে যেসব ধারা অপপ্রয়োগের কারণে ডিএসএকে নিবর্তনমূলক আইন হিসেবে অ্যাখায়িত করা হয়, সেগুলো প্রস্তাবিত আইনেও থাকছে। সাইবার আইনে ডিএসএর মতো মোট ৬০টি ধারা থাকছে। এতে পাঁচটি ধারা অজামিনযোগ্য রাখা হয়েছে। অর্থাৎ নাম পাল্টালেও এ আইনের কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে না।

তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে অনেক পরিবর্তন আসছে। ডিজিটাল আইনের চেয়ে শাস্তি কমছে; ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। মানহানির ক্ষেত্রে শুধু জরিমানা হবে। সংশয়ের জায়গাগুলো স্পষ্ট করা হয়েছে। তাই হয়রানি কমবে। এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত আইনে গণমাধ্যমের জন্য আলাদা কোনো বিধান রাখা হয়নি। বিদ্যমান মামলাগুলো সাইবার নিরাপত্তা আইনে চলবে বলে জানান মন্ত্রী। নতুন আইনে কোনো বিতর্কিত ধারা থাকবে কিনা– জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, আইনটি নিয়ে কোনো বিতর্ক হবে না। ডিএসএর বিভিন্ন ধারার পরিবর্তনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো সন্তুষ্ট হবে কিনা– জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, সেটা তাদের বিষয়।

ডিজিটাল আইনের প্রস্তাবিত পরিবর্তনকে ‘আইওয়াশ’ বলেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক। তিনি সমকালকে বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়টি সাইবার আইনে থেকে গেছে। এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। আইনে কিছু শাস্তি কমানো হয়েছে। আইন বাতিল হচ্ছে না। নতুনভাবে আগের আইনটিই প্রয়োগ হবে।
এ বিষয়ে বিএফইউজের সাবেক সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আগে হওয়া আইসিটি আইনের একটি ধারা নিয়ে বড় ধরনের আপত্তি ছিল। তখন সরকার বলেছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হলে ৫৭ ধারা বাতিল করা হবে। তা-ই করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৫৭ ধারার উপাদানগুলো বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। এখন প্রস্তাবিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩’-এ সেই ৫৭ ধারার কৌশলই অবলম্বন করা হয় কিনা, তা দেখার বিষয়। যদি তেমন চেষ্টা থাকে, তাহলে আমাদের উদ্বেগ থেকেই যাবে।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পাস হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ডিজিটাল আইনে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মামলা হয়েছে। এ আইনের মামলায় গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক আহমেদ ২০২১ সালে কারাগারে মারা যান। এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ধর্মীয় ও অন্যান্য অনুভূতিতে আঘাতের ঠুনকো অভিযোগে মামলা ও গ্রেপ্তারের কারণে ডিএসএ নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা সমালোচনা হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফোলকার টুর্ক এ আইনকে স্থগিত করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের শর্তের সঙ্গে সংগতি রেখে সংস্কারের আহ্বান জানান। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এ আইনের সমালোচনা করে তা বাতিলের দাবি জানায় বিভিন্ন সময়ে। জাতিসংঘ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা সম্পূর্ণ বাতিল এবং আটটি ধারার সংশোধন চায়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে গত মে মাসে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল হবে না। তবে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তেমন কিছু বিষয় সংশোধন হবে। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিসভা ডিএসএ বাতিল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করার অনুমোদন দিল।

সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পার্থক্য

২৮ পৃষ্ঠার সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া পর্যালোচনায় দেখা যায়, ডিজিটাল আইনের প্রতিটি ধারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। তবে অপরাধের শাস্তি কমানো হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৮, ৩১ ও ৩২ ধারা অজামিনযোগ্য হলেও প্রস্তাবিত আইনে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এ ছাড়া দ্বিতীয়বার একই অপরাধের ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে থাকা দ্বিগুণ শাস্তির বিষয়টি প্রস্তাবিত আইনে রাখা হয়নি।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ও ২৯ ধারা বাতিল বিষয়ে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহলের দাবি ছিল শুরু থেকেই। এর মধ্যে ২৮ ধারা প্রস্তাবিত আইনে বহাল রেখে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। ডিএসএর ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করা বা উস্কানি দেওয়ার জন্য ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করে, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে তা অপরাধ হবে। এই অপরাধের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল। তা কমিয়ে কারাদণ্ড দুই বছর ও জরিমানা পাঁচ লাখ টাকা হচ্ছে।

সাংবাদিকদের জন্য নিপীড়নমূলক ডিএসএর ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে তিনি তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। প্রস্তাবিত আইনে কারাদণ্ড থাকছে না। কিন্তু জরিমানা পাঁচ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড হতে পারে।

ডিএসএর ৩১ ধারায় বলা হয়েছিল, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়, তাহলে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল সাত বছর ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। অজামিনযোগ্য এই ধারায় জামিন দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। সাত বছরের কারাদণ্ড কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের শাস্তি আগে ছিল ১৪ বছর; সেটি কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে।

৩৩ ধারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে হ্যাকিং সম্পর্কিত অপরাধ নামে নতুন ধারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এই অপরাধের শাস্তি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।

ডিএসএর ৩৩ ধারায় বলা হয়েছিল, যদি কোনো ব্যক্তি কম্পিউটার বা ডিজিটাল সিস্টেমে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে সরকারি ও আধা-সরকারি সংস্থার তথ্য স্থানান্তর বা স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তা অপরাধ বলে ধরা হবে।

পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার করা যাবে

ডিএসএর বিতর্কিত ৪৩ ধারা পরিবর্তন করা হচ্ছে না। এ ধারা অনুসারে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যদি মনে করেন, কোনো স্থানে এ আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে কোনো পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, সরঞ্জাম জব্দ, দেহ তল্লাশি এবং গ্রেপ্তার করতে পারবেন। এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে যেসব সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়, তা জব্দ না করলে প্রমাণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে কারণে এটি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।

নতুন আইন যেন দমনের হাতিয়ার না হয়

সাইবার নিরাপত্তা আইন যেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক এবং কণ্ঠরোধ ও ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার না হয়, সে আহ্বান জানিয়েছে বিভিন্ন সংস্থা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক দপ্তর এক টুইটে গতকাল বলেছে, সাইবার নিরাপত্তা আইন করার যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে যেন ডিজিটাল আইনের দমনমূলক বৈশিষ্ট্যগুলো ফিরিয়ে আনা না হয়।

এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি যেভাবে নিবর্তনমূলক এবং কণ্ঠরোধ ও ভিন্নমত দমনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল, নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনটি যেন তেমন না হয়। এ আইন যেন শুধু সাইবার অবকাঠামোর নিরাপত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং যাতে কোনোভাবেই সাইবার অবকাঠামো তথা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে স্বাধীন ও ভিন্নমত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা না হয়।’

নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে চলমান মামলার শাস্তি কি হবে?

প্রশ্ন উঠেছে পুরোনো আইনের (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) মামলা এবং সেগুলোর শাস্তি এখন কী হবে- এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী জানান, এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। গণমাধ্যমকে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আইনের অবস্থান হলো যেসব অপরাধ পুরোনো আইনে করা হয়েছে, সেই পুরোনো আইনে যে শাস্তি, সেই শাস্তি অপরাধীকে দিতে আদালত বাধ্য। কিন্তু সেখানে চিন্তাভাবনা করা হবে, এই (প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন) আইনে যেহেতু শাস্তির পরিমাণ অনেকাংশে কমানো হয়েছে এবং সেই কমানোটিই সরকারের এবং আইনসভার উদ্দেশ্য। তাই সেই কমানোটি যাতে বাস্তবায়িত হয়, সেই চেষ্টা করা হবে।’

এডু ডেইলি ২৪