হিন্দু পদবী সমূহ : নামের পদবীর ইতিহাস এবং হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান পদবী তালিকা
হিন্দু পদবী সমূহ : নামের পদবীর ইতিহাস এবং হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান পদবী তালিকা [লেখক : খগেন্দ্রনাথ ভৌমিক] : হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ বিশাল ভূখণ্ড আমাদের দেশ ভারতবর্ষ। আর্যদের ভারত আগমনের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা জাতির আগমন ও সংমিশ্রণ হয়েছে আমাদের এই দেশে।
বহু ভাষাভাষী ভারতজনের দেশে বিচিত্র আচার ব্যবহার ও নানা ধর্মে বিশ্বাস নিঃসন্দেহে বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন। বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে। খ্রীস্টান, মুসলমান প্রতি ধর্মাবলম্বী জাতিগুলি ছাড়া হিন্দু, জাতির প্রধান চারটি বর্ণের অসংখ্য বিভাগ ও উপজাতিগুলির বিভিন্ন গােষ্ঠী বর্তমান। ভারত-ইতিহাসের প্রাচীনত্বের নিরিখে হিন্দু জাতির প্রত্যেক ব্যক্তির বর্ণ ও গােষ্ঠী অনুযায়ী নিজস্ব পদবী ধারণের প্রথা অবশ্য নিতান্তই অর্বাচীন। কালক্রমে বিচিত্র পরিস্থিতিতে নতুন নতন পদবীর উদ্ভব হয়। সেই পদবীগুলির সংকলন ও পদবী বিষয়ক তথ্যগুলির আলােচনাই এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য।
মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে যেমন কয়েকটি শব্দের প্রয়ােজন তেমনি প্রত্যেক ব্যক্তির প্রাথমিক পরিচয়ে অন্তত দুটি শব্দের একান্তই দরকার। সেই শব্দ দুটির প্রথমটি ‘নাম’ (NAME) এবং অপর শব্দটিকে ‘উপনাম’ বলা হয়। এই উপনাম শব্দটিই সাধারণ অর্থে প্রচলিত ‘পদবী’ (SURNAME)। কেবলমাত্র নাম দ্বারা কোন ব্যক্তির পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না; সম্যক পরিচয়ের জন্য পদবীটি অত্যাবশ্যক। কোন ব্যক্তি তার নামের দ্বারা কোন বিশেষ মহলে পরিচিত হলে তার পরিচয়ে আর পদবীর প্রয়ােজন হয় না; পক্ষান্তরে, কোন ব্যক্তি তার পদবীর দ্বারা কোন বিশেষ মহলে পরিচিত থাকলে তার পরিচিতিতেও নাম নিস্প্রয়ােজন হতে পারে। তবে নাম ও পদবী একসঙ্গে যুক্ত না-হলে কোন ব্যক্তিরই পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না। নাম ও পদবীর মাঝে চন্দ্র, কুমার, লাল, নাথ, বরণ, রঞ্জন, ভূষণ, রাণী, বালা প্রভৃতি যে-পদগুলি ব্যবহৃত হতে দেখা যায় ঐগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে লিঙ্গবােধক ; কদাচিৎ কোন স্থলে নিছক অলংকার মাত্র। নাম ও পদবীর মাঝে ঐরপ যে-কোন একটি পদের ব্যবহার নিতান্তই ব্যক্তির ইচ্ছাধীন। মধ্যপদটি ব্যবহার না করলেও পরিচয়ের কোন হেরফের হয় না।
এখন যেমন ব্যক্তির নামের শেষে পদবী থাকে, প্রাচীনকালে অনরপ পদবী কেউ ব্যবহার করতেন না। গুণকর্ম অনুসারে আর্য চতুর্বর্ণের পদবী ধারণের প্রথম ধর্মীয় নির্দেশ পাওয়া যায় যথাক্রমে মনুসংহিতা ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ থেকে।
এই দুটি শ্লোক থেকে স্পষ্টই প্রতিপন্ন হয় যে, ব্রাহ্মণের “শৰ্মা” ও “দেবশর্মা, ক্ষত্রিয়ের “বৰ্মা” ও “রায়বর্ম” বা অনুরুপ কোন রক্ষাকর্মবাচক উপাধি, বৈশ্যের “ভূতি” বা অনুরুপ কোন পুষ্টিক্রিয়াবােধক উপাধি এবং শদ্রের “দাস” বা অনুরূপ কোন সেবকার্থক উপাধির ধারা বর্ণের পরিচয় হবে। কিন্তু বৈদিক যুগ থেকে যে-সব বিশেষ বিশেষ নামের সঙ্গে আমরা পরিচিত সেই সব নামের শেষে পদবী দেখা যায় না; যেমন—বলি, অম্বরীশ, বিপশ্চিৎ, হরিশ্চন্দ্র, (রাজা) দশরথ, (রাজর্ষি) জনক, যুধিষ্ঠির, দুর্যোধন প্রভৃতি। পুরাণ, রামায়ণ ও মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থে কাহারও নামের শেষে পদবীর উল্লেখ নাই। রাজন্যবর্গ ছাড়া বহ, মহামুনি ও ঋষির নামও শাস্ত্রগ্রন্থগুলিতে উল্লেখিত আছে, যাঁদের নাম এখনও গােত্রে ও প্রবরে বিদ্যমান। তাদের নামের শেষেও বর্ণজ্ঞাপক কোন পদবী দেখা যায় না। একাধিক পুরাণে বৈশ্যদের উপাখ্যান আছে, কিন্তু তাদের নামের শেষে বর্ণজ্ঞাপক “ভূতি” অথবা “ধন” শব্দের উল্লেখ নাই। সুতরাং এরূপ সিদ্ধান্তে আসতে পারা যায় যে, শাস্ত্রীয় দ্বাদশ সংস্কার ও ক্রিয়াকাণ্ড ব্যতীত ধর্মীয় নির্দেশ অনুযায়ী নামের সংগে বর্ণের পরিচায়ক শমা, বৰ্মা, ভূতি ও দাস ব্যবহৃত হত না। বৈদিক ও পৌরাণিক যুগের যে-সব রাজর্ষি ও রাজন্যবর্গের নাম পর্বে উল্লেখ করা হয়েছে সে-সব নাম থেকে পরিষ্কার প্রমাণিত হয় যে, ব্যক্তির নাম বারাই তার পরিচয় প্রকাশ ও পরবর্তীকালে তাঁর বংশের পরিচিতি হত; যেমন—“কুরুবংশ”, “রঘুবংশ” ইত্যাদি। তখন পদবীর বারা বংশ পরিচিতি হত না। পৌরাণিক যুগের দীর্ঘদিন পরে হিন্দু সমাজে ধীরে ধীরে নামের সাথে সমাসবদ্ধ পদরূপে পদবীর সংযুক্তি দেখা দিতে থাকে; উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়—ভবভূতি, দেবদাস, দেবদত্ত, বিষ্ণুশর্মা, ধর্মগুপ্ত, অনিমিত্র ইত্যাদি। বংশানুক্রমিকভাবে যদিও কয়েক শতাব্দী এইভাবে নামের সংগে পদবীর ব্যবহার চলছিল কিন্তু পদবীর দ্বারা বংশের পরিচয় হত না। কালক্রমে দেবদত্ত স্থলে দেবরুপ দত্ত, বিজয় সেন স্থলে বিজয়কুমার সেন এবং বিষ্ণুশর্মা স্থলে বিষ্ণুসেবক শর্মা ইত্যাদি ব্যবহৃত হতে আরম্ভ হল এবং পদবী বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ায় পদবীর দ্বারা বংশ পরিচিতি শুরু হল। আবার এও দেখা যায় যে, অতীতে ব্যক্তিগত নামগুলি ছিল একটিমাত্র শব্দ; যেমন, দুর্লভ, গরুড়, কলশথ ইত্যাদি। কোন কোন ক্ষেত্রে বন্ধুমিত্র, ধৃতিপাল, চিরাতদত্ত। এ প্রসংগে এও উল্লেখযােগ্য যে, আজকের বঙ্গদেশের পদবী চট্ট, বর্মন, পাল, মিত্র, দত্ত, নন্দন, দাস, ভদ্র, দেব, সেন, ঘােষ ও কুণ্ড, অতীতের নামের শেষাংশ কিনা তা নিয়েও পণ্ডিত সমাজে মতভেদ রয়েছে।
ভারতের বিভিন্ন অংশে বংশ-পরিচিতির ধারক “পদবী” বা “পারিবারিক নাম”. ব্যবহারের বিভিন্ন রীতি পরিলক্ষিত হয়। বাঙ্গালী ও মহারাষ্ট্রবাসী ছাড়া অন্যের ততটা পদবী ব্যবহার করেন না। ভারতের দক্ষিণ অংশে অঞ্চলের নামই পারিবারিক নাম বা পদবী, যা ব্যক্তিগত নামের পর্বে বসানাে হয়। আবার কারাে কারাে নামের পর্বে তাঁর পিতার নাম যােগ করা হয়; যেমন, সর্বপল্লী রামস্বামী ভেকটমন— ক্রমানুসারে প্রথম—পারিবারিক নাম বা পদবী যা অঞ্চলেরও নাম; দ্বিতীয় পিতার নাম; এবং সর্বশেষে ব্যক্তিগত নাম। তামিলনাড়ুর লােকেরা সাধারণত পদবী ছাড়াই তাঁদের নাম লেখেন। তবে তাঁদের পরিচয়ে যে-চারটি শব্দ ব্যবহার করেন তার প্রথম শব্দটি তাঁদের আদি বাসস্থানের নাম, দ্বিতীয় শব্দটি পিতার নাম, তৃতীয় শব্দটি নিজের নাম ও শেষের শব্দটি পদবী। কুম্ভকোলম, রঙ্গস্বামী পদ্মনাভ আয়েঙ্গার- এই শব্দ কয়টির দ্বারা উক্ত পদ্ধতিতে একজনের পূর্ণ পরিচয় রয়েছে। তবে আয়েঙ্গার পদবী ব্যবহার না-করলে তার নাম হত পদ্মনাভন। পশ্চিমাঞ্চলের পদ্ধতিতে দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকার ক্রমানুসারে প্রথমটা ব্যক্তিগত নাম, দ্বিতীয়টা পিতার নাম এবং শেষটি অঞ্চলের নাম বুঝায়।
নিজস্ব বা ব্যক্তিগত নামের মতােই পদবী বা পারিবারিক নাম দ্বারা অনেককেই কে কোন স্থানের অধিবাসী তা সহজেই নির্ণয় করা যায়; যেমন, দক্ষিণভারতে সুব্রহ্মণ্য, মহালিঙ্গ প্রভৃতি ব্যক্তিগত নাম আর আইয়ার ও আয়েঙ্গার ইত্যাদি পারিবারিক নাম বা পদবী। পূর্বভারতে ব্যক্তিগত নাম রাসবিহারী, হরেকৃষ্ণ ইত্যাদি আর মুখােপাধ্যায়, বাসু প্রভৃতি পারিবারিক নাম বা পদবী। ভারতের পশ্চিমে ও দক্ষিণাংশে প্রায়ই অঞ্চলের নামেই পারিবারিক নাম বা পদবী রচিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে পশ্চিম অঞ্চলে প্রায়ই পারিবারিক নামগুলি তাদের আদি বাসস্থানের নামের শেষে “কার” শব্দ যােগ করে গঠন করা হয় ; যেমন, বিজয় পারকার—যার পরিবার বিজাপুরের আদি বাসিন্দা।
পদবী গ্রহণে হিন্দুর প্রতি শাস্ত্রের নির্দেশ থাকায় ও পদবীর দ্বারা মানুষের সামাজিক মর্যাদা তথা সমাজজীবনে তার স্থান নির্দিষ্ট হওয়ার প্রাথমিক রীতি প্রচলিত থাকায় হিন্দু ধর্ম তথা সমাজজীবনের প্রাসংগিক তথ্যগুলি আলােচনা এখানে অপরিহার্য।
হিন্দু সমাজ ও বিবর্তন
প্রাকবর্ণবিভাগ যুগে এক আর্য পিতার বিভিন্ন সন্তান বিভিন্ন বৃত্তি অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাদের বৃত্তিবাচক কোন পরিচয় বা ভাগ ছিল না। পরে বিভিন্ন বৃত্তিকে জ্ঞান, শৌর্য, অর্থ ও সেবা এই চারটি ভাগে ভাগ করে এই সব বৃত্তি গ্রহণকারীদের বৃত্তি বা কর্মভিত্তিক ভাগে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র নামে চতুর্বণে ভাগ করা হয়। (বণের এক অর্থ গণ; গুণানুসারে প্রত্যেককে উক্ত বৃত্তি বা কর্মের জন্য বরণ করা হল)। গুণের দ্বারা কর্মপ্রাপ্তি সাধারণ অর্থে কমে দক্ষতা বা কর্মপটতা বুঝায়। কিন্তু গুণের অপর অর্থ—সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিন প্রাকৃতিক গুণ। প্রত্যেক ব্যক্তিরই প্রাকৃতিক তিনগুণের একটি না একটির প্রাধান্য থাকে এবং সেই গুণাশ্রয়ী কর্মে ব্যক্তির কর্মদক্ষতা দিন দিন বৃদ্ধি পায়। জ্ঞান, শৌর্য, অর্থ ও সেবা কর্মগুলিতে উক্ত প্রাকৃতিক গুণের প্রভাবে কর্মদক্ষতা বা পটুতাই বর্ণসৃষ্টির সূত্ররূপে গৃহীত হয়ে থাকে। সত্ত্বগুণ সম্পন্ন সাত্ত্বিক প্রকৃতির লােক যাঁরা, তাঁরা মুক্তসংগ, অহংবাদশূন্য, ধৃতিমান, উৎসাহী ও সিদ্ধসিদ্ধ বিষয়ে নির্বিকার ত্যাগী পুরুষ। যারা রজোগুণ সম্পন্ন রাজসিক প্রকৃতির লােক তারা প্রভুত্ব, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, সুখসম্পদের অভিলাষী। তমােগুণ সম্পন্ন তামসিক প্রকৃতির মানুষ অত্যধিক নিদ্রা, আলস্য, ভয় ও মঢ়তায় আচ্ছন্ন। প্রকৃতির এই তিন গণভেদ অনুযায়ী মানুষের কর্মক্ষেত্রও মূলত তিন প্রকার। আর ঐ গুণগত কর্মভেদ অনুযায়ী হিন্দুধর্মে বর্ণের সৃষ্টি হয়েছে। অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যথাশাস্ত্র ধর্মনিশীলন, যাগযজ্ঞ সমাপন ও ‘সর্বজনহিতায়’ কর্মে পৌরােহিত্য করণ সত্ত্বগুণ সম্পন্ন ব্রাহ্মণের কম। রজোগুণজাত প্রভুত্ব, ক্ষমতালােভ, সুখসম্পদ ভােগ, দেশরক্ষা, দেশের শান্তিরক্ষা ও প্রয়ােজনবােধে যুদ্ধবিগ্রহ করা ক্ষত্রিয়ের কর্ম। আর, রজোগুণের আধিক্য ও তমােগুণের অল্পতায় কৃষি ও বাণিজ্য দ্বারা দেশের ধনবৃদ্ধি বৈশ্যের কম। কায়িক শ্রমের দ্বারা অন্য তিন বর্ণকে তাদের নিজ নিজ কর্মে সাহায্য করাই তমােগণ সম্পন্ন শূদ্রের কর্ম। উক্ত প্রাকৃতিক গুণত্রয়ের প্রত্যেকটি গুণই অভ্যাস ও পারিপাবিক অবস্থার প্রভাবে বধিত বা হ্রাসপ্রাপ্ত হতে দেখা যায়।
উল্লেখিত গুণগত কর্মভেদের চারটি ভাগের অন্যতম জ্ঞানবলের প্রতীক ব্রাহ্মণ তাঁদের জ্ঞান, বুদ্ধি, অহংভাবশূন্যতা প্রভৃতি সত্ত্বগুণের বলে সমাজকে পরিচালিত করতেন। সমাজের সবাই তাঁদের মুখের কথায় চলত বলে তারা সমাজরূপী বিরাটের মুখস্বরুপ। শৌর্য বা বাহুবলের প্রতীক ক্ষত্রিয়—তাঁরা মূলত রজোগুণের অধিকারী বলে তাঁদের বাহুবল দ্বারা সমাজের রক্ষণাবেক্ষণ বা শান্তিরক্ষা করতেন। সমাজকে রক্ষা করতেন বলেই তারা সমাজরূপী বিরাটের বাহুস্বরূপ। ধনবলের প্রতীক বৈশ্য প্রধানত রজোগুণান্বিত—তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্যদ্বারা ধনের সংস্থানে লিপ্ত থাকতেন। উরু যুগল যেমন উদরকে ধারণ করে সেইরপ সমাজের উদর পােষণে লিপ্ত থাকতেন বলেই তাঁরা সমাজরূপী বিরাটের উরুঘরপ। আর শ্রমবলের প্রতীক শূদ্র তমােগুণাগত; তাঁরা কায়িক শ্রমের দ্বারা অন্য তিন বর্ণের কর্মের সহায়তা করতেন। পদযুগলকে নির্ভর করে উর, উদর ও মস্তিষ্ক দণ্ডায়মান বলেই তাঁরা সমাজরূপী বিরাটের পদযুগল স্বরুপ। এখানে সমাজকে বিরাটত্বে স্থান দিয়ে তার সেবায় চারটি কর্মের বারাই চতুর্বর্ণের উৎপত্তি প্রতিপন্ন। কিন্তু ব্রহ্মার মুখ হতে ব্রাহ্মণের, বাহু হতে ক্ষত্রিয়ের, উরু হতে বৈশ্যের ও পদ হতে শূদ্রের উৎপত্তি, এই মতের যৌক্তিকতা গ্রহণযােগ্য কিনা তা ভাববার বিষয়। কারণ, চতুর্বেদের মধ্যে ঋগ্বেদ আর্য তথা হিন্দুদের প্রাচীনতম গ্রন্থ, এবং তাতে গণভিত্তিক চতুবর্ণ সৃষ্টির কথা উল্লেখ আছে; আর, বৈদিক যুগের অনেক পরে ঋগ্বেদ সংহিতায় “ব্রহ্মার মুখ হতে ব্রাহ্মণের উৎপত্তি” ইত্যাদি লােকের দ্বারা গুণগত কর্মভেদের স্থলে জন্মগত অধিকারের কথা পরিলক্ষিত হয়। এবংবিধ বিভিন্ন মতগুলি গবেষকদের গবেষণার বিষয়।
কর্মের দ্বারা চারটি বর্ণের সৃষ্টি হলেও তখন উহা জন্মগত ছিল না গুণকর্মভিত্তিক ছিল। বর্ণে বর্ণে যে কোন বিভেদ ছিল না তা নিম্নোক্ত আলােচনাদিতে প্রতীয়মান—প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণপত্র গণভ্রষ্টতায় এবং কর্ম বা বৃত্তিতে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্রেরপে খ্যাত হয়েছেন এবং শূদ্রতনয়ও গুণগত উৎকর্ষের জন্য ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছেন। দাসীপুত্র কবষও একজন বৈদিক ঋষি হয়েছিলেন এবং “ভর্তৃহীনা জবালার” পুত্র সত্যকামও “দ্বিজোত্তম” ব্রাহ্মণ বলে গণ্য হয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ আরও বলা যায়, বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় কুলে জন্মগ্রহণ করেও ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছিলেন। আবার, পরশুরাম ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করলেও কর্মের জন্য ক্ষত্রিয় বলে পরিগণিত হন।
ব্রাহ্মণ গুণগত বৈশিষ্ট্যে বর্ণের শ্রেষ্ঠরপে গণ্য হলেও তার ক্ষত্রিয়াদি ত্রিবর্ণের অন্ন গ্রহণের কোন নিষেধবিধি যে ছিল না তার প্রমাণ বহু পুরাণ ও সংহিতায় দেখতে পাওয়া যায়। যাজ্ঞবল্ক্য, পরাশর, বিষ্ণু ও যম প্রভৃতি সংহিতায় এবং অগ্নি, আদিত্য ও কর্ম প্রভৃতি পুরাণে এইরপ বিধানের উল্লেখ আছে। বাস্তবক্ষেত্রেও অনুরুপ সামাজিক ব্যবহার ছিল। বর্ণগুলির পরস্পরের মধ্যে বিবাহপ্রথা প্রচলিত ছিল,—ব্রাহ্মণেরা ক্ষত্রিয়, বৈশ্যা, শূদ্রা; ক্ষত্রিয়েরা বৈশ্যা, শূদ্রা; বৈশ্যেরা শূদ্রা পত্নী গ্রহণ করলে তা অনুলােম; আর, ক্ষত্রিয়েরা ব্রাহ্মণী; বৈশ্যেরা ক্ষত্রিয়া বা ব্রাহ্মণী; শূদ্রেরা বৈশ্যা, ক্ষত্রিয়া বা ব্রাহ্মণী পত্নী গ্রহণ করলে তাকে প্রতিলােম বিবাহ বলা হত। শাস্ত্র পুরাণে অনুলােম ও প্রতিলােম বিবাহের দৃষ্টান্তের অভাব নাই। বর্ণগুলির মধ্যে স্পর্শ দোষ ছিল না। শাস্ত্রবিধি অনুসারে শূদ্র পাচকের রান্নাকরা অন্নাদি অন্য বর্ণের হিন্দুরা ভক্ষণ করতেন। মনুসংহিতায় আছে, দাস্যকর্ম দ্বারা জীবিকা অর্জনে অক্ষম হলে শূদ্র পাচকের বৃত্তি গ্রহণ করে তার পরিবার প্রতিপালন করবে।
আর্যগণের গণভিত্তিক বর্ণবিভাগ কালক্রমে বর্ণকেন্দ্রিক ও বংশভিত্তিক হয়ে দাঁড়ানাের মূলে রয়েছে ঐ চতুর্বর্ণের প্রত্যেক পরিবারের সন্তানদের প্রতি পিতৃপুরুষের অপত্যস্নেহ এবং সন্তানের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অভিভাবনা। ফলে ব্রাহ্মণ তাঁর সন্তানদের বেদ অধ্যয়ন করাতেন এবং নানা শাস্ত্রে সপশ্চিত করে তুলতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু যে-সন্তান ব্রাহ্মণের গুণের অধিকারী হতে পারতেন না কালক্রমে তিনিও ব্রাহ্মণরূপে স্বীয় বর্ণের সর্বকর্মের অধিকারী হতে লাগলেন। অনুরুপভাবে, ক্ষত্রিয়গণ তাঁদের সন্তানদের যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে চেষ্টা করতেন কিন্তু কোন ক্ষত্রিয়নন্দন যুদ্ধ বা শাসনকার্যে পারদর্শিতা দেখাতে না পারলেও ক্ষত্রিয়রূপে পরিচিত হতেন। একইভাবে, অনুপযুক্ত হয়েও বৈশ্যের ছেলে বৈশ্য ও শদ্রের ছেলে শুদ্র বলেই পরিচিত হতেন। এইরপে প্রত্যেক বর্ণই নিজ নিজ কর্মগত স্বার্থ রক্ষায় সতত তৎপর থাকতেন। ফলত গুণভিত্তিক বর্ণবিভাগের অবকাশ রইল না। তবে তখনকার সমাজব্যবস্থায় বর্ণভিত্তিক কর্মবিভাগ থাকার ফলে বংশগত কমে নৈপুণ্য অর্জনের সুযোেগ স্বভাবতই প্রত্যেক বর্ণের সন্তানেরা পেত। কিন্তু পরবর্তীকালে নতুন ও পরিবর্ধিত সমাজব্যবস্থায় পর্বের সফলদায়ক গুণগত বর্ণবিভাগের স্থলে দেখা দিল জন্মের অধিকারে বর্ণের অধিকার এবং বর্ণের অধিকারে কর্মের অধিকার। সমাজস্বার্থের উপরে স্থান পেল সংকীর্ণ পারিবারিক স্বার্থ বা ব্যক্তিস্বার্থ। এবং ফলত বর্ণে বর্ণে গড়ে উঠল বিরাট ব্যবধান ও বিভেদের প্রাচীর। স্বার্থান্ধ মানুষের দ্বারা জ্ঞান, শৌর্য, অর্থ ও সেবা, কর্মের এই চারটি মূলভাব চতুর্বর্ণের গণ্ডিতে আবদ্ধ হওয়াতে বর্ণে বর্ণে বিভেদ সৃষ্টি হয়েই শেষ হল না; অতঃপর ঐ কর্মগুলির স্তর, শাখাস্তর ও বিভিন্ন উপস্তরে কর্মরত মানুষগুলিকে চিহ্নিত করা হল এক একটি পৃথক জাতের মানুষরুপে। এইরপে বিভিন্ন কর্ম বা বত্তি অবলম্বনকারীরা তাদের বংশানুক্রমিক প্রথার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন জাতে পরিণত হল। ক্রমে জাতিগত কর্মগুলির বিভিন্ন স্তরে মানানুযায়ী উচ্চ-নীচ নির্দিষ্ট হতে লাগল। আর, এর ব্যাপক প্রসারের ফলে দেখা দিল জাতপাতের ভেদ-বিচার। এবং জন্মসূত্রে বর্ণ ও শ্রেণী নির্ধারণের সরল ব্যবস্থার ফলে মানুষের সহজাত বৃত্তি এবং স্বাভাবিক গুণ বিকাশের আর কোন সযােগ রইল না।
আনুমানিক খ্রীস্টপূব পঞ্চম শতাব্দী থেকে খ্রীস্টীয় সপ্তম শতকের শেষ অবধি বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য ছিল। এই বৌদ্ধ ধর্ম জাতিভেদ এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিশেষ আঘাত হেনেছিল; ফলে জাতিভেদের কঠোরতা অনেকটা শিথিল হয় এসেছিল। দীর্ঘদিন ধরে বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য এবং বিশেষত বৌদ্ধ শাসনের ফলে ব্রাহ্মণের প্রাধান্য বা জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা না থাকায় উচ্চ-নীচ জাতপাতের ভেদাভেদ ছিল না। অসবর্ণ বিবাহের বহুল প্রচলন হয়েছিল। বৌদ্ধ রাজশাসন ও ধর্মের প্রভাবে চতুর্বর্ণের মধ্যে পংক্তিভােজন ইত্যাদি প্রথা প্রবর্তিত হয়েছিল।
খ্রীস্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুত্থান সুরু। আর, তখন থেকেই বঙ্গদেশে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব স্তিমিত হতে থাকে। অবশ্য পাল রাজাদের আমল অবধি বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ছিল। কারণ, পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ। সেন রাজাদের শাসনকালে আবার হিন্দু সমাজের পুনর্গঠন আরম্ভ হয়। এই পুনর্গঠনের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন রাজা বল্লাল সেন। তার রাজসভায় নানা শাস্ত্রে বিশারদ বড় বড় পণ্ডিতের সমাবেশ হয়েছিল। তাঁদের সাহায্যে হিন্দু সমাজে পুনরায় জাতিভেদ প্রথা প্রবর্তিত হয়। বল্লালসেন যে শুধু হিন্দু সমাজের পুনর্গঠন করলেন তা-ই নয়, কর্মভেদ অনুযায়ী এমনভাবে নতন ৩৬টি জাত বা শ্রেণীর সৃষ্টি করেছিলেন যাতে সমাজে বিভেদের সূচনা হল। এবং শ্রেণীতে শ্রেণীতে উচ্চনিন্দবােধ তথা প্রভেদ অনেক বেড়ে গেল। এককথায়, বিষবৃক্ষের বীজ রােপিত হল।
এই বীজ থেকে অংকুরিত বিভেদের বিষবৃক্ষ মহীরুহে পরিণত হয়ে তার শাখাপ্রশাখা ছড়াল। হিন্দু সমাজে দেখা দিল শ্রেণী, গােষ্ঠী, পৃশ্য, অস্পৃশ্য ইত্যাদি কত কী রকমারি বিভেদ। ব্রিটিশ ভারতের প্রথম আদমশুমারীতে দেখা যায়, ভারতে প্রায় চার হাজার শ্রেণীর লোক বাস করত। হিন্দু সমাজে ছুৎমার্গ এবং পতিত ও দুষ্ট শ্রেণী ঠিক কখন দেখা দেয় তার প্রামাণিক কাল উল্লেখ করা না গেলেও বলা যায় যে, বঙ্গদেশে সেন রাজাদের আমল থেকেই এর ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়। সেন রাজাদের সময়ে বৌদ্ধধর্মে যখন ভাটার টান এবং হিন্দু ধর্মে এসেছে জোয়ারের স্রোত তখন থেকে বৌদ্ধরা দলে দলে হিন্দু সমাজে ফিরে আসতে লাগল। যারা প্রথমেই এল তাদের সমাদরেই গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু যারা এল না অথবা দুই-এক পুরুষ পরে কিংবা আরও বেশি বিলম্বে হিন্দু সমাজে প্রত্যাবর্তন করল তাদের পর্যায়ক্রমে বিচার করে অনাচরণীয়, ভ্রষ্ট, পতিত, অস্পৃশ্য ইত্যাদি শ্রেণীর লােক বলে গণ্য করা হল। এবং সমাজে এরা পতিত বলেই থেকে গেল।
রাজবংশের উৎসাহে ও পষ্ঠপােষকতায় হিন্দু সমাজের পুনরায় উত্থান ও পুনর্গঠন হল এবং কেবলমাত্র জন্মাধিকারে ব্রাহ্মণগণ শ্রেষ্ঠ বর্ণরূপে শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকাণ্ডের অদ্বিতীয় বিধায়ক, হােতা, ধারক ও বাহকরূপে নির্দিষ্ট হলেন। গুণাশ্রয়ী কর্মভিত্তিক বর্ণবিভাগের সুযােগ সমাজে না-থাকায় উল্লেখিত অনাচরণীয়, ভ্রষ্ট, পতিত ও অস্পৃশ্যরপে চিহ্নিত মানগুলির যাঁরা নিজ গুণে ও সাধনায় ব্রাহ্মণ ও উন্নত পর্যায়ের জাতিগুলির সমকক্ষ তাঁরাও অবহেলিত এমনকি ঘৃণিত থেকে গেলেন। হিন্দু শাস্ত্রকারদের নানা প্রকার কঠোর বিধানে এবং সেন রাজাদের সময় থেকে হিন্দু সমাজে সেই সব অনুশাসনগুলি কঠোরতর ভাবে প্রয়ােগের ফলে ব্রাহ্মণবর্ণসহ সকল উন্নত পর্যায়ের জাতগুলির শ্রেণীস্বার্থ ও বিশেষভাবে ব্রাহ্মণদের প্রভুত্ব বজায় থাকল বটে কিন্তু সমাজে বিভেদ শতগুণে বর্ধিত হল। এইভাবে দীর্ঘদিন চলার পর ব্রিটিশ শাসনে দেশে পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার প্রবর্তন ও তার প্রভাব হিন্দু সমাজে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেয়।
বঙ্গদেশে তথা ভারতের অন্যান্য প্রদেশে স্কুল-কলেজগুলিতে সমাজের সর্বশ্রেণীর জনগণই শিক্ষার স্বাধীনতা ও সুযোেগ লাভ করায় তথাকথিত অনাচরণীয়, ভ্রষ্ট, পতিত ও অস্পৃশ্যরপে চিহ্নিত জাতের মানুষগুলিও নিজেদের শিক্ষিত ও নানাভাবে যােগ্য করে তােলার সুযোেগ লাভ করেন। এবং ক্রমে তাঁদের পর্বের শ্রেণীগত নির্দিষ্ট কর্মের গন্ডি ছাড়িয়ে যােগ্যতা অনুসারে বিভিন্ন সম্মানজনক কর্মে নিয়ােজিত হতে থাকেন। পক্ষান্তরে, ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উন্নত শ্রেণীগুলির অশিক্ষিত ও অযােগ্য লােকদেরও সাধারণ কর্ম গ্রহণ করতে হয়। জাতিবর্ণ নির্বিশেষে গুণ বা যােগ্যতার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় কমের দ্বারা সমাজের তথাকথিত উন্নত ও অনুন্নত লােককে চিহ্নিত করার সুযোেগ আজ অবলুপ্তির পথে। তবে একদা যে কর্মদক্ষতা বা যােগ্যতা কমভিত্তিক চতুর্থ বিভাগের সূত্ররূপে গৃহীত হয়েছিল সেই কর্মদক্ষতা বা যােগ্যতার মাপকাঠিতে বিভিন্ন স্তরে কর্মে নিযুক্ত লােকদের জন্য নতুন করে সমাজ গঠন হচ্ছে বা হবে কিনা তা সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়।
হিন্দু পদবী সমূহের উৎপত্তি
সংখ্যাতীত পদবীগুলির উৎপত্তি হয়েছে নানা কারণে। পদবী, উপাধি ও খেতাবগুলির উৎপত্তিগত বৈচিত্র্য রয়েছে বটে কিন্তু নামের শেষে একাকার হয়ে ব্যবহারের দরণ এগুলি মৌলিকত্ব হারিয়েছে এবং কোনগুলি পদবী, কোনগুলি উপাধি আর কোনগুলি খেতাব তা এখন আর সাধারণত চেনার উপায় নেই। ইংরেজরাজ যেমন সমাজের উচ্চ স্তরের লােক অর্থাৎ বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, জ্ঞানে, মর্যাদায়, সম্পদে এবং জনসাধারণের উপর প্রভাবে শীর্ষস্থানীয়দের ‘রায়বাহাদুর’, ‘স্যার’, ‘নাইট’ প্রভৃতি উপাধি বিতরণ করতেন এবং ভারত সরকারও ‘ভারতরত্ন’, ‘পদ্মভূষণ’ প্রভৃতি উপাধি বিতরণ করছেন, ঠিক তেমনি পর্বে হিন্দু রাজন্যবর্গ এবং মুসলমান সম্রাটগণ সভ্রান্ত ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের নানারপ উপাধি বা খেতাবে ভূষিত করতেন।
সেই সব উপাধি বা খেতাবের অনেকগুলি তাঁরা তাঁদের নামের শেষে পদবীরূপে ব্যবহার করতেন। এবং তা-ই তাদের বংশধরগণ পরম্পরাগতভাবে ব্যবহার করে আসছেন। মুসলমান রাজত্বে বিভিন্ন সরকারী পদের বিভিন্ন নাম ছিল। ঐ নামগুলিতে বা নামগুলির শব্দার্থে রাজকর্মচারিগণ পরিচিত হতেন এবং তাঁরা ঐ নামগুলি তাদের নিজ নিজ নামের শেষে পদবীরূপেও ব্যবহার করতেন। তাঁদের বংশের সন্তানগণ তাদের নামের শেষেও ঐগুলি পদবীরূপে ব্যবহার করে আসছেন।
এ কথাও উল্লেখযােগ্য যে, প্রচলিত বিভিন্ন নামের জাতগুলির অনেকের নামও অনেক ক্ষেত্রে পদবীরূপে বংশপরম্পরায় চলে আসছে। আবার, বসবাসের অঞ্চল ও স্থানের নামও পদবীরূপে বংশপরম্পরায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শিক্ষিত লােকেরা অনেক সময় নিরক্ষর ও দরিদ্র লােকদের অবজ্ঞাসূচক কোন কোন শব্দ দ্বারা চিহ্নিত করেছেন; তা-ও পদবীপে বংশপরম্পরায় চলে আসার নজির রয়েছে। তাছাড়া দেবতা, প্রাণী ও দ্রব্যের নামও পদবীরূপে বংশপরম্পরায় প্রচলিত। ব্যক্তির কর্মের নামে ও নামাৰ্থে, গুণের নাম বা নামাৰ্থেও বংশগত পদবীর সৃষ্টি হয়েছে। কোন কোন পদবী আবার পরিচ্ছন্ন অর্থবহও নয়, অথচ সেগুলি বংশপরম্পরায় ব্যবহারের দৃষ্টান্ত বিরল নয়।
পিতামাতার দেওয়া নাম ও বংশগত পদবী অনেকেই চিরকাল বহন করে না, পরিবর্তনও করে নেয়। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৭৫ খ্রীস্টাব্দের পর নাম ও পদবী পরিবর্তনের আইনসম্মত অধিকার স্বীকৃত হয়। আর, ঐ সময় থেকে নাম ও পদবী পরিবর্তিত হয়ে আসছে। নাম ও পদবী যেমন ভিন্ন তেমনি ঐ দুটি পরিবর্তন করার উদ্দেশ্যও ভিন্ন। বাপমায়ের দেওয়া সেকেলে অসুন্দর নামের কারণে যে-পরিহাসের সম্মুখীন হতে হয় তার থেকে পরিত্রাণের ইচ্ছা নাম পরিবর্তনের একটি বিশেষ ও মুখ্য কারণ। পদবী পরিবর্তনের কারণ কিন্তু অনেক এবং বিচিত্র। আইনানুগ তিনটি পদ্ধতিতে পদবী পরিবর্তিত হয়ে আসছে।
প্রথমত, প্রচলিত প্রথা ও আইন অনুযায়ী বিবাহের পরে স্ত্রী তাঁর পৈত্রিক পদবী ত্যাগ করে স্বামীর পদবী গ্রহণ করেন অর্থাৎ স্বামীর পদবীতে পরিচিত হন। তবে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যদি কোন মহিলা বিবাহের পূর্বে তার পৈত্রিক পদবীতে বিশেষ পরিচিতি বা প্রসিদ্ধি লাভ করেন তবে তিনি বিবাহের অব্যবহিত পইে তার পূর্ব পরিচিতির সূচক পদবীটিকে সহসা ত্যাগ করেন না। আবার, অনেক ক্ষেত্রে পৈত্রিক পদবীর সংগেই স্বামীর পদবী যুক্ত করে নাম প্রকাশ করে থাকেন। দ্বিতীয়ত, ধর্মান্তরিত হলে পদবীর পরিবর্তন হয়ে থাকে। তবে সে ক্ষেত্রে শুধু পদবীই নয় নামেরও পরিবর্তন দেখা যায়।
কিন্তু ব্যতিক্রম এখানেও রয়েছে কোন কোন ক্ষেত্রে নাম ও পদবীর কোনটিরই পরিবর্তন হয় না। তৃতীয়ত, শ্রুতিমধুর নয় বা নিজের ভাল লাগে না এরপ পদবী পরিবর্তন করে প্রচলিত পদবীগুলির মধ্যে রুচিসম্মত একটি গ্রহণের ঝোঁক ছাড়াও পদবীসূত্রে সমাজে অপেক্ষাকৃত উচ্চ মর্যাদা লাভের মানসিকতা পদবী পরিবর্তনের কারণ বলেই ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্যান্য শ্রেণী, গােষ্ঠী প্রভৃতির অন্তর্ভুক্ত মানুষের পদবী পরিবর্তনের প্রবণতা এত বেশী। বিশেষ করে পদবী পরিবর্তন করেও আইনানুগ সযােগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হওয়ায় তফসিলী সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের পদবী পরিবর্তনের প্রবণতা আরও বেশী। অর্থাৎ যেসব পদবীতে জাত, সম্প্রদায়, শ্রেণী, কুল বা গােষ্ঠীর নাম প্রকাশ পায় বা বংশানুক্রমিক জীবিকার ইঙ্গিত বহন করে সেই পদবীগুলি লােকে পরিবর্তন করে নিতে চান, এবং এই মর্মে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আদালতে আইনসম্মত এফিডেভিটও করে নেন।
প্রসংগক্রমে উল্লেখযােগ্য, ভারতে কোন কোন স্থানে অবাঙ্গালী হিন্দু সমাজে ঝুনঝনওয়ালা, পালকীওয়ালা, বাটলিওয়ালা প্রতি বৃত্তিমূলক পদবী রয়েছে এবং পাশ্চাত্য দেশগুলিতেও বংশানুক্রমিক কারপেনটার, বুচার, পটার প্রভৃতি বৃত্তিমূলক পদবী আছে। কিন্তু এরা এই সব বৃত্তিজ্ঞাপক পদবীর জন্য কোন লজ্জা বা সংকোচ বােধ করেন না যেহেতু এদের সমাজে বৃত্তি বা কর্মের বিচারে মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয় না। অতএব এরা পদবী পরিবর্তনের চিন্তাও করেন না। কিন্তু এ দেশে বিশেষ করে বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে বিভিন্ন নামের অসংখ্য জাত বা সম্প্রপ্রদায়, কুল বা গােষ্ঠীর উৎপত্তি কর্ম বা বৃত্তির ভিত্তিতে এবং ঐ কর্ম বা বৃত্তি সামাজিক মর্যাদা নিরুপণের মাপকাঠি হওয়াতে অর্থাৎ কর্ম বা বৃত্তির নিক্তিতে সমাজে উচ্চ-নীচ স্থান নির্দিষ্ট থাকায় প্রচলিত পদবীর মধ্যে যেগুলির দ্বারা বিশেষ করে কায়িক শ্রমােপজীবী গােষ্ঠীগুলি নির্দেশিত হয় সেই সব পদবী সংশ্লিষ্ট গােষ্ঠীর সকলেই বর্জন করছেন এমন নয়।
তবে সংস্লিষ্ট গােষ্ঠীর যাঁরাই শিক্ষায়-দীক্ষায়, ধনে-মানে উন্নত হচ্ছেন তারা গােষ্ঠীগত পদবী পালটে এমন পদবী নিচ্ছেন যাতে তাদের বংশগত কমের সন্ধান মেলে না। আবার, এইসব গােষ্ঠীভুক্ত এমন অনেকেই আছেন যারা বংশগত কর্ম আর করছেন না অথচ বংশগত বা কৌলিক পদবী ব্যবহার করে যাচ্ছেন এবং তার দরুণ প্রচলিত নিয়মেই সমাজে । অবজ্ঞার পাত্র বলে চিহ্নিত হচ্ছেন। এরাও পদবী পরিবর্তন করছেন মলত সামাজিক অবজ্ঞা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে। এইভাবে যিনিই পদবী বদল করে নিচ্ছেন তাঁর পরবর্তী বংশধরগণ নতুন পদবীতেই পরিচিত হচ্ছেন।
কোন কোন ক্ষেত্রে আবার পরিবার, সকলেই পদবী একসঙ্গেই বদলে নেওয়া হচ্ছে। এইরূপ বদলানাের ফলে অনেক পরিবারই তাদের আত্মীয়, শ্রেণী বা গােষ্ঠীগত পরিচয় থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বংশপরম্পরায় আত্মীয়তা থাকায় বা একই শ্রেণীর বা গােষ্ঠীর লােক হিসাবে পরিচিত থাকায় পদবী বদলানাের পরেও তাদের শ্রেণী বা গােষ্ঠীগত সামাজিক বন্ধনের হেরফের হয় নি। কিন্তু দেশবিভাগের ফলে ও জীবিকা অর্জনের কারণে একই শ্রেণী বা গােষ্ঠীর লোেক বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ায় ও স্বেচ্ছামত পদবী পরিবর্তন করায় আত্মীয়তা ও গােষ্ঠীগত সমাজবন্ধন উত্তরােত্তর শিথিল হয়ে যাচ্ছে।
দুই-এক পুরুষ পরে একই গােষ্ঠীর লােক হয়েও তাদের পারিবারিক, সামাজিক ও আত্মিক ঐক্য বিনষ্ট হওয়াটা বিচিত্র নয়। এ কথাও উল্লেখযােগ্য যে, একই বংশের অনেকেই তাদের কৌলিক পদবী পালটে বিভিন্ন পদবী গ্রহণ করলেও পদবীর দ্বারা বংশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রয়ােজনে নতুন নেওয়া পদবী পালটে পুনরায় কৌলিক পদবীতে ফিরে আসতেও দেখা যায়। আবার, পরিবর্তিত নতুন পদবীতে সম্পত্তি ও জমি-জমা সংক্রান্ত দাবি প্রমাণের অসুবিধা হওয়ায় দলিলাদিতে লিখিত কৌলিক পদবীতে প্রত্যাবর্তনের নজিরও রয়েছে।
পদবী পরিবর্তনের ফলে বাঙ্গালী হিন্দুর জাতকুল বা সম্প্রদায়, শ্রেণী বা গােষ্ঠীর স্বতন্ত্র পরিচয় যেমন লােপ পাচ্ছে তেমনি অবাঙ্গালী হিন্দু সমাজে বাঙ্গালী নামকরণের ধরনটি অনুকরণের দরণ বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী হিন্দু সমাজের লােককেও তাদের নিজ নিজ গণ্ডিতে চিহ্নিত করার উপায় থাকছে না।
বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী নামকরণে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার দ্বারা কে বাঙ্গালী হিন্দু, আর কে অবাঙ্গালী হিন্দু তা বুঝতে পারা যায়। যদিও উপাধ্যায়, মিশ্র, ত্রিবেদী প্রভৃতি অনেকগুলি পদবী হিন্দু বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী উভয়ের মধ্যে প্রচলিত তবে বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী নামের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য থাকায় পদবী এক হলেও কে বাঙ্গালী আর কে অবাঙ্গালী, এতদিন তা বুঝা যেত।
কিন্তু বাঙ্গালী ধরনে রঞ্জন, প্রদীপ, চিত্ত, প্রশান্ত, চন্দন প্রভৃতি নামগুলি অবাঙ্গালীর দ্বারা ব্যবহৃত হওয়ায় বাঙ্গালী অবাঙ্গালী চেনার উপায় থাকছে না এ ছাড়াও অগণিত পদবীর মধ্যে এমন অনেক পদবী রয়েছে যেগুলির ব্যবহারে প্রাথমিকভাবে বাঙ্গালী অবাঙ্গালীকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করাও এক সমস্যার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ঐরূপ পদবীর আগে বাঙ্গালী ধরনের নাম দেখলে এই সমস্যা আরও জটিল হয়ে ওঠে।
বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী হিন্দু ছাড়াও হিন্দু ও মুসলমানের গণ্ডি চিহ্নিত করার ব্যাপারেও অসুবিধা দেখা দিচ্ছে। চৌধুরী, বিশবাস, মণ্ডল, মজুমদার, সরকার, সিকদার ইত্যাদি খেতাব/উপাধি যেমন হিন্দু সমাজের অনেক সম্প্রদায়ের কৌলিক পদবী হিসাবে ব্যবহৃত তেমনি মুসলমান সমাজেও পদবীরূপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে হিন্দু-মুসলমান ভেদে নামকরণের স্বাতন্ত্যে পদবীর মিল থাকলেও এবং অবাঙ্গালী হিন্দুর ন্যায় মুসলমানদের বাঙ্গালী ধরনে অনিরুদ্ধ, অভিজিত, সব্যসাচী প্রভৃতি নামকরণ চাল হলেও কাজী, সিরাজ প্রভৃতি পদবীগুলি নামের আগে ও পরে থাকায় হিন্দু মুসলমান চেনার অসুবিধা দেখা দেয় নি। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যেও হিন্দু ধরনে নামকরণের ব্যাপক প্রচলন এবং কাজী, সিরাজ প্রভৃতি পদবী ব্যতিরেকে সেই নামগুলির শেষে চৌধুরী, বিশ্বাস, মণ্ডল, মজুমদার, সরকার, সিকদার (হিন্দু-মুসলমান উভয়ের মধ্যে প্রচলিত) ইত্যাদি পদবী যুক্ত হলে প্রাথমিক পর্যায়ে হিন্দু ও মুসলমানের গন্ডি চেনারও উপায় থাকে না।
বাঙ্গালী খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করলে নাম ও কৌলিক পদবীর পরিবর্তন করতে হয়। তবে বাধ্যবাধকতা না থাকলেও কোন কোন ক্ষেত্রে আলফ্রেড, ইমানুয়েল, পল, পিটার, মাটিনা, মাইকেল প্রভৃতি খীস্টীয় মহাপুরুষদের নাম অনেকেই তাঁদের বাঙ্গালী নাম ও পদবীর আগে ব্যবহার করায় আলফ্রেড ঘােষ, ইমানুয়েল দিলীপ বাড়ৈ, পল পরমানন্দ বিশ্বাস, পিটার প্রসন বিশ্বাস, মার্টিনা হালদার ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রভৃতি নামে পরিচিত হওয়ায় বাঙ্গালী খ্রীস্টানদের পথক গণ্ডি চেনার অসুবিধা হয় না।
কিন্তু খ্রীস্টীয় মহাপুরুষদের নাম বর্জন করলে প্রাথমিক পর্যায়ে বাঙ্গালী হিন্দু, ও বাঙ্গালী খ্রীস্টানদের গণ্ডি চেনার উপায় থাকে না। আদিবাসী সমাজের মধ্যে গােত্রের (CLAN) খুব প্রচলন। এই গােত্রের নাম হয়ে থাকে জীবজন্তুর, গাছপালার কিংবা কোন জড় পদার্থের নাম থেকে। গােত্রের নামকে ওঁরা পদবী হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন। এঁদের নামকরণের বেলাতেও বাঙ্গালী নামের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে অর্থগত সামঞ্জস্য থাকলেও ভাষাগত পার্থক্য থাকায় এবং তার সংগে গােত্রগত পদবীযুক্ত হওয়ায় শ্রীমঙ্গরা (মঙ্গলবার জাত) কুজর, শ্রীবিরষা টির্কে, শ্ৰীবৃদ্ধ (বধবারে জাত) কচ্ছপ প্রভৃতি নামের দ্বারা আদিবাসী সমাজের লােক হিসাবে তাঁদের পরিচয় বিশিষ্ট হয়ে ওঠে।
আদিবাসী সমাজের যাঁরা খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন তাঁরা বাঙ্গালী খ্রীস্টানদের ন্যায় অ্যালেকসাস, এন্টনী, উইলিয়ম, বার্নাড, মার্টিনা, পাটরাস, এডওয়ার্ড, ইলিয়াস, জোসেফ, জন, বেনাদিক, জেভিয়ার, ডােমিনিক, পিটার, এম্যানুয়েল, হিলারিয়াস, অ্যালােইস, ইয়ারটিউ, ইয়াকুব, ফ্রান্সিস, জেমস, বেয়াতর প্রভৃতি প্রীস্টীয় মহাপুরুষদের নাম গ্রহণ করে তা তাঁদের গােত্রগত পদবীর আগে ব্যবহার করায় শ্রী অ্যালেকসাস কুজুর, শ্রী এন্টনী লাকড়া, শ্রী ইলিয়াস এক্কা প্রভৃতি নামের ব্যক্তিকে আদিবাসী খ্রীস্টানররূপে চিনতে অসুবিধা হয় না।
কিন্তু আজকাল আবার অনেক ক্ষেত্রে বাঙ্গালী হিন্দু ধরনে কালীপদ, শান্তি, সুধীর, দিলীপ ইত্যাদি নামকরণও চালু হয়েছে। তবে অবাঙ্গালী হিন্দু, মুসলমান ও বাঙ্গালী খ্রীস্টানদের ন্যায় আদিবাসী সমাজে বাঙ্গালী ধরনে নামকরণ হলেও সেই নামের পরে তাঁদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গােত্রগত পদবী যুক্ত হলে আদিবাসী সমাজের লােক হিসাবে চিনতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু আদিবাসী সমাজের মুণ্ডা জাতির মধ্যে নাগ ও ইদানীং রায়, সিং, মণ্ডল, সরদার ইত্যাদি পদবী; খারিয়া জাতির মধ্যে মণ্ডল, সরদার; ওঁরাও জাতির মধ্যে মণ্ডল, সরদার; এবং সাঁওতাল জাতির মধ্যে মাঝি ইত্যাদি বাঙ্গালী পদবীগুলি ব্যবহার করায় প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁদের আদিবাসী সমাজের লােক হিসাবে চিহ্নিত করার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অদর বা সদর ভবিষ্যতেও যদি বাঙ্গালী ধরনে নামকরণ ও পদবী গ্রহণের দ্বারা শ্রী কালীপদ সরদার, শ্রী শান্তি রায়, শ্রীসুধীর নাগ, শ্রী দিলীপ মণ্ডল প্রভৃতি নাম ব্যাপক হারে চালু হয় তা হলে দৃশ্যেত নামের ভিত্তিতে বাঙ্গালী হিন্দু ও আদিবাসী সমাজের লােক আলাদা করে চেনার সমস্যা উত্তরােত্তর বেড়েই যাবে।
আবার, বাঙ্গালী পদবীধারীর সহিত খ্রীস্টান পদবীধারিণীর বিবাহজাত পুত্রের, শ্যেন প্যাটরিক সিংহ, ও কন্যার, স্যারন প্যাটরিসিয়া সিংহ নামকরণে পিতার কৌলিক পদবীর সংগে মাতার কৌলিক পদবীও যুক্ত হওয়ার নজির দেখা যায়। কিন্তু পিতার “সিংহ” (কৌলিক) পদবীটি যুক্ত না-হলে পুত্রকন্যাকে বাঙ্গালী হিন্দু বংশসদ্ভুতরূপে কিছুতেই চিহ্নিত করা যেত না। আবার, বিবাহসূত্রে আবদ্ধ পার্শী সম্প্রদায়ভুক্ত মহিলার “এঞ্জিনিয়ার” (কৌলিক পদবী) ত্যাগ ও প্রাক-বৈবাহিক “জারিন” (নাম) রেখে তার সংগে স্বামীর “চৌধুরী” পদবী যুক্ত “জারিন চৌধুরী” উল্লেখ করতে দেখা যাচ্ছে।
এঞ্জিনিয়ার পদবী-বিহীন জারিন নামের দ্বারা তাঁর কৌলিক সম্প্রদায় চিহ্নিত করা কিছুটা দুষ্কর। কারণ বাঙ্গালী হিন্দু স্ত্রী-পুরুষের নামকরণে এখন ততটা গোঁড়া হিন্দুয়ানী দেখা যায় না। তবে আলােচ্যক্ষেত্রে যেহেতু শ্ৰীমতী জারিনের কৌলিক পদবী ও বিবাহােত্তর চৌধুরী পদবীর পুত্র আমাদের জানা (এর স্বামী স্যার আশুতােষ চৌধুরীর নাতি। সুতরাং একজন অহিন্দু মহিলার হিন্দু পদবী গ্রহণের নজির হিসাবে জারিন চৌধুরী উল্লেখযােগ্য। সুইডিস রমণী “লিশা” বিবাহসূত্রে বাঙ্গালীর “চৌধুরী” পদবীতে “লিশা চৌধুরী”।
আর, তার গর্ভজাত কন্যা চেহারায় মেমসাহেব, নিজের নাম উচ্চারণে “অনীটা” বললেও পিতৃপরিচয়ে পুরােপুরি বাঙ্গালী মহিলারুপে “অনীতা চৌধুরী”-র নামও উল্লেখযােগ্য। অনুরূপভাবে উল্লেখ্য, ইংরেজ মহিলা, বাঙ্গালী হিন্দু ডঃ সুখেন্দ, বিশ্বাসের পত্নী আইলিন লেভিনা বিবাসের নাম। বাঙ্গালী মহিলারাও অবাঙ্গালী তথা অহিন্দুদের সংগে বিবাহের পত্রে তাদের নামের শেষে কোথাও কোথাও নিজ নিজ স্বামীর পদবীর সংগে তাঁদের কৌলিক পদবী যুক্তভাবেও ব্যবহার করে থাকেন। যেমনঃ গৌরী আয়ুব দত্ত, কেতকী কুশারী ডাইসন ইত্যাদি।
গৌতমবুদ্ধের প্রবর্তিত “বৌদ্ধ ধর্ম” জাতি বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই গ্রহণ করার সুযোেগ রয়েছে। পদবী ধারা: এই ধর্মাবলম্বীদের চিহ্নিত করার উপায় নাই। বড়ুয়া পদবী এদের মধ্যে বেশী প্রচলিত থাকলেও বাঙ্গালী হিন্দুর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবহৃত পদবী দাশগুপ্ত, রায়, বিশ্বাস, হােড়, সিংহ, সিনহা, মুৎসন্দী, দাস, মজুমদার, তালুকদার, যাদব, কার্বারী, নাগ, পাল, দেওয়ান, সেন, সাহা, সরকার, রুদ্র, ঠাকুর এবং আদিবাসী সমাজের চাকমা, লামা, শেরপা প্রভৃতি পদবী এই ধর্মাবলম্বীদের নামের শেষে দেখা যায়।
অর্থাৎ, ধর্মান্তর গ্রহণ সত্ত্বেও তাঁদের সম্প্রদায়গত কৌলিক পদবী অবিকৃত থাকে। একইভাবে, শ্রীশ্রীচৈতন্যদেব প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত অধিকারী, গােসাই, গােস্বামী প্রভৃতি পদবী বা অন্য কোন পদবী দ্বারা এই ধর্মমতের কাকেও চিহ্নিত করার উপায় নাই। কারণ, এগুলি সবই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কৌলিক পদবী, যা তারা বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণের পূর্বেও ব্যবহার করতেন। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর প্রচারিত বৈদিক ধর্মানুসারে সদাচারী আর্যসমাজভুক্ত লােকদেরও পদবীর দ্বারা আর্যসমাজী বলে চেনার উপায় নাই। সমাজের নামানুসারে “আর্য” শব্দটি কেউ কেউ পদবী হিসাবে ব্যবহার করলেও অনেকেই তাদের নিজ নিজ কৌলিক পদবীই নামের শেষে ব্যবহার করে থাকেন। ব্রাহ্মসমাজীরাও তাঁদের কৌলিক পদবীই অবিকৃতভাবে ব্যবহার করে থাকেন। তবে তাদের মধ্যে আচার্য পদ যাঁরা পান তাঁরা তাঁদের নামের পর্বে আচার্য শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন।
এমন কিছু উপাধি আছে যেগুলি শুধু কর্মের সঙ্গেই সম্পর্কিত এবং জাতিধর্ম নির্বিশেষে তাদেরই প্রাপ্য যারা শুধু সেই সব কর্মে লিপ্ত। এ ধরনের উপাধি পরিবর্তনের ঝোঁক দেখা যায় না, কারণ এ উপাধগুলি বংশপরম্পরায় ব্যবহার করার রীতি নেই। আবার, এমন উপাধি বা খেতাবও রয়েছে যেগুলি বিতরিত হয় সেই সব মানুষের মধ্যে যারা এ উপাধি বা খেতাবগুলি পাওয়ার যােগ্য। এরপ উপাধি বা খেতাবও তাঁদের বংশে ধারাবাহিকরুপে ব্যবহার করার সযােগ থাকে না।
পূর্বে বলা হয়েছে যে, প্রাচীন হিন্দু সমাজ ছিল উদার মানুষ গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে বর্ণের মর্যাদা লাভ করত অর্থাৎ গুণ ও কর্মের বলে ক্ষত্রিয়ের ব্রাহ্মণত্ব লাভে বাধা ছিল না। অনুরূপভাবেই বৈশ্য হতে পারত ক্ষত্রিয় বা ব্রাহ্মণ এবং শূদ্র লাভ করত বৈশ্য, ক্ষত্রিয় বা ব্রাহ্মণের বর্ণমর্যাদা। পরবর্তীকালে তথা আধুনিক যুগে সমাজে যেমনটি চলছে অর্থাৎ জন্মের ভিত্তিতে বর্ণ ও জাতি নিদিষ্ট হচ্ছে তার বদলে যদি পূর্বের মতােই গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে বর্ণ ও জাতি নির্ধারিত হত এবং প্রধানত বত্তি বা কর্মের মানদণ্ডে সামাজিক মর্যাদা ও স্থান নিরুপণের বিভেধাত্মক ব্যবস্থাটি যদি না-থাকত তাহলে পদবী পবির্তনের এমন ব্যাপকতা হয়ত দেখা যেত না।
হিন্দু নামের পদবীর তালিকা
আমরা বাঙালি জাতি। বাঙালি জাতির সমাজ সংস্কৃতি অন্যান্য জাতির থেকে আলাদা। আর আজকে আমি আপনাদের সাথে আমাদের বাঙালি জাতির একটা দিক নিয়ে আলোচনা করব। সেটা হলো গিয়ে পদবী। অর্থাৎ বাঙালি জাতির বিভিন্ন পদবী। তাও আবার ধর্ম ভিত্তিকভাবে ভাগ করে পদবীগুলো তুলে ধরা হলো। যাতে আপনাদের বিষয়টা বুঝতে সহজ হয়। আমাদের দেশে প্রধান চারটি ধর্ম। তার মধ্য এক নম্বরে হলো – ইসলাম, দ্বিতীয় নম্বরে হলো – হিন্দু, তৃতীয় নম্বরে হলো – বৌদ্ধ এবং চতুর্থ নম্বরে হলো – খ্রিস্টান ধর্ম। তো বাঙালি জাতির পদবীগুলো এই ধর্ম ভিত্তিকভাবে ভাগ করা। যা নিচে তুলে ধরা হলো।
বাঙালি মুসলমানদের পদবীসমূহৱ
বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত বাঙালি মুসলমানদের পদবীসমূহ বেশ বৈচিত্রপূর্ণ। এখানে যেমন ধর্মীয় প্রভাব বিদ্যমান তেমনই ঐতিহ্যবাহী পেশাকেও পদবী হিসেবে গ্রহণের রেওয়াজ বিদ্যমান।
- ধর্মীয় পদবীসমূহ : খন্দকার, সৈয়দ, মীর, আনসারী, গাজী, চিশতী, পীর, ফকির, মাস্তান/মাস্তানা, মোল্লা, শাহ, খাজা, মির্জা।
- ভূ-স্বামী হিসেবে প্রাপ্ত পদবী : খন্দকার, আখন্দ/আকন্দ গোমস্তা, চৌধুরী, জায়গীরদার, তরফদার/তপদার, তালুকদার, চাকলাদার, ডিহিদার, ঠাকুর, পন্নী, ভূঁইয়া/ভূঁঞা।
- পেশা হিসেবে প্রাপ্ত পদবী : কাজি, কানুনগো, কারকুন, গোলন্দাজ, দেওয়ান, নিয়াজী, পটোয়ারী, মণ্ডল (পদবী), মলঙ্গী, মল্ল (পদবী), মল্লিক, মাতুব্বর, মুন্সি/মুন্সী, মুহুরী, মৃধা, লস্কর, সরকার (পদবী), হাজারী, প্রামাণিক, পোদ্দার, মজুমদার, সরদার (পদবী), হাওলদার, শিকদার, জোয়ার্দার, ইনামদার।
- সম্মানসূচক পদবী : খাঁ/খাঁন/খান, পাঠান (পদবী), প্রধান (পদবী), বিশ্বাস (পদবী), শেখ, মিঞা/মিয়া/মিয়াজী।
- অন্যান্য : লোহানী, ঢালী, মুস্তাফী/মুস্তফী।
বাঙালি হিন্দুদের পদবীসমূহ
বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত বাঙালি মুসলমানদের মত হিন্দুদের পদবীসমূহ বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ এখানে যেমন ধর্মীয় জাতিভেদ প্রথার প্রভাব বিদ্যমান তেমনই ঐতিহ্যবাহী পেশাকেও পদবী হিসেবে গ্রহণের রেওয়াজ বিদ্যমান।
ব্রহ্মক্ষত্রিয় : সেন রাজাদের শিলালিপি থেকে জানা যায়, তাঁরা ছিলেন চন্দ্রবংশীয় ‘ব্রহ্মক্ষত্রিয়’ (যাঁরা আদিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন, পরে কোনো কারণে ক্ষত্রিয়ের পেশা গ্রহণ করেন)। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, সেনরা প্রথমে জৈন আচার্য বংশোদ্ভূত ছিলেন। পরে শৈবধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু এই মত নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
ব্রাহ্মণদের পদবীসমূহ : উপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায়/গাঙ্গুলী, চট্টোপাধ্যায়/চ্যাটার্জি, বন্দোপাধ্যায়/ব্যানার্জি/বাড়ুজ্যে, মুখোপাধ্যায়/মুখার্জি, চক্রবর্তী, শর্মা, দেব শর্মা, ভাঁদুড়ি, ঘোষাল, কৃষ্ণ/কৃষ্ণণ, ঠাকুর চক্রবর্তী, ঠাকুর, বাগচী, গোস্বামী, আচার্য, ভট্টাচার্য, মৈত্র, চৌধুরী (উপাধি), রায়চৌধুরী (উপাধি), রায় (উপাধি), বিশ্বাস (উপাধি), মল্লিক (উপাধি), মুস্তাফি (উপাধি)।
- ভূ-স্বামীদের প্রাপ্ত পদবী : চাকলাদার, রায়, চৌধুরী, ঠাকুর, বর্মন, মণ্ডল, মল্লিক, রায়চৌধুরী, দস্তিদার, খাস্তগীর, মহলানবীশ।
- বৈশ্য কপালী : ভৌমিক।
- নমঃশূদ্র বা নমঃস্বেজ : ভক্ত, বারুই, করাতী।
- পেশা হিসেবে প্রাপ্ত পদবী : কানুনগো, কারিগর, কর্মকার, শীল, গোঁসাই, ত্রিবেদী, দেওয়ান, পালাকার, পোদ্দার, প্রমাণিক, ভাঁড়, মজুমদার, মালাকার, সরকার, হাজরা, হালদার।
- অন্যান্য : গুণ, বালা, জলদাস, জলধর, দাসগুপ্ত, পাল, সাহানী/সোহানী বর, খাঁ, রং।
বাঙালি বৌদ্ধদের পদবীসমূহ
বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত বাঙ্গালী মুসলমান ও হিন্দুদের মত বৌদ্ধদেরও পদবীসমূহ বেশ বৈচিত্রপূর্ণ। এখানে যেমন ধর্মীয় প্রভাব বিদ্যমান তেমনই ঐতিহ্যবাহী পেশাকেও পদবী হিসেবে গ্রহণের রেওয়াজ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার দেখা যায় যে, ভিনদেশীয় পদবীকে গ্রহণ করা হচ্ছে কিছুটা পরিমার্জন করে।
- ভূ-স্বামী হিসেবে প্রাপ্ত পদবী : চৌধুরী, দেওয়ান।
- পরিমার্জিত পদবী : বড়ুয়া, মুৎসুদ্দী।
- অন্যান্য : পাল।
কায়স্থদের পদবীসমূহ
গুপ্ত, মিত্র, সিংহ, রুদ্ৰ, কর, বিশ্বাস, দে, ঘোষ, বসু, গুহ, গুহরায়, দাস/দাশ, নন্দী, সেন, ভদ্র।
বাঙালি খ্রিস্টানদের পদবীসমূহ
বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত বাঙ্গালী মুসলমান, হিন্দু ও বৌদ্ধদের মত খ্রিস্টানদেরও পদবীসমূহ বেশ বৈচিত্রপূর্ণ। এখানে যেমন ধর্মীয় প্রভাব বিদ্যমান তেমনই ঐতিহ্যবাহী পেশাকেও পদবী হিসেবে গ্রহণের রেওয়াজ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার দেখা যায় যে, ভিনদেশীয় পদবীকে গ্রহণ করা হচ্ছে কিছুটা পরিমার্জন করে।
- পর্তুগীজ পদবীসমূহ : গোমেজ/গমেজ, ডি কস্তা, রোজারিও/ডি রোজারিও।
- পেশা হিসেবে প্রাপ্ত পদবী : মন্ডল, মল্লিক, সরকার, হালদার।
- অন্যান্য : দত্ত।
তাহলে আজকে আমরা আমাদের বাঙালি জাতির ধর্ম ভিত্তিক পদবীগুলো সম্পর্কে জেনে নিলাম। আজকের মত আমার এখানেই পোস্টটি শেষ। এইরকম আরো পোস্ট পেতে আমার সাথেই থাকুন।