সান্ডা কি? সান্ডা খাওয়া কি হালাল নাকি হারাম? সান্ডা ও গুইসাপ এর মধ্যে পার্থক্য

Rate this post

সান্ডা কি : বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এক ধরনের সরীসৃপ প্রাণীকে “সান্ডা” নামে ডাকা হয়। আবার কেউ কেউ একে গুইসাপ বা গোসাপও বলে থাকেন। তবে এই দুই প্রাণীর মধ্যে আদৌ কোনো পার্থক্য আছে কিনা, সান্ডা খাওয়া হালাল না হারাম – এসব নিয়ে অনেকের মনে বিভ্রান্তি কাজ করে।

 

এই নিবন্ধে আমরা জানব :

  • সান্ডা কী?

  • সান্ডা খাওয়া হালাল না হারাম?

  • সান্ডা ও গুইসাপের মধ্যে পার্থক্য কী?

এসব প্রশ্নের উত্তর কুরআন-হাদীস, বিজ্ঞান এবং সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের আলোকে খোঁজার চেষ্টা করবো।

সান্ডা কী?

সান্ডা হলো এক ধরনের মরুভূমির বাসিন্দা টিকটিকি জাতীয় প্রাণী। ইংরেজিতে একে বলা হয় Spiny-tailed lizard বা Uromastyx। এই প্রাণীটি মূলত মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, পাকিস্তান, ও ভারতের কিছু অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। এদের দেহ মোটা, লেজ কাঁটার মতো শক্ত ও কাঁটায় ভরা।

সান্ডার বৈশিষ্ট্য:

  • দৈর্ঘ্য: ২৫-৭০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে

  • খাদ্য: গাছপালা, লতা-পাতা (তৃণভোজী)

  • লেজ: মোটা ও শক্ত, আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করে

  • বেঁচে থাকা: গর্তে বাস করে, দিনের বেলা বাইরে আসে

  • ত্বক: খসখসে, বাদামি বা ধুসর রঙের

ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে সান্ডার গুরুত্ব

অনেক হাদীসে উল্লেখ আছে যে, নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সামনে সান্ডা পেশ করা হয়েছিল। তিনি নিজে খাননি, তবে সাহাবীদের নিষেধ করেননি। ফলে অনেক ফকীহ সান্ডাকে হালাল হিসেবে গণ্য করেছেন।

সান্ডা খাওয়া কি হালাল না হারাম?

সান্ডা খাওয়া নিয়ে ইসলামি শরিয়তে ভিন্নমত রয়েছে। নিচে হানাফি, শাফেয়ী, মালিকি ও হাম্বলি মাযহাব অনুযায়ী মতামত তুলে ধরা হলো:

✅ হালাল মতামত:

  • ইবনে আব্বাস (রা.) ও ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, সান্ডা খাওয়া বৈধ।

  • হাদীসে আছে, “রাসূলুল্লাহ (সা.) সান্ডা খাননি, তবে নিষেধও করেননি।” – (বুখারী, মুসলিম)

❌ হারাম বা অপছন্দনীয় মতামত:

  • হানাফি মাযহাবে সান্ডা খাওয়াকে মাকরুহে তাহরিমি বলা হয়েছে, অর্থাৎ খাওয়া উচিত নয়।

  • কারণ এটি দেখতে ভীতিকর এবং সাধারণত মানুষের মধ্যে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করে।

📜 হাদীসের রেফারেন্স:

“একবার রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে সান্ডা পরিবেশন করা হয়। তিনি সেটি খাননি। সাহাবীগণ বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এটা কি হারাম?’ তিনি বললেন, ‘না, তবে এটা আমার জাতির ভূখণ্ডে ছিল না, তাই আমি এটি পছন্দ করি না।’”
– (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১৯৪৫)

সান্ডা ও গুইসাপ এর মধ্যে পার্থক্য

বাংলাদেশে সাধারণত “গুইসাপ” নামে যে প্রাণীটি পরিচিত, সেটি একেবারেই ভিন্ন একটি প্রজাতির প্রাণী। এই দুটি প্রাণীর মাঝে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।

বিষয়সান্ডা (Uromastyx)গুইসাপ (Monitor Lizard)
ইংরেজি নামSpiny-tailed lizardMonitor Lizard
বৈজ্ঞানিক নামUromastyx spp.Varanus spp.
বাসস্থানমরুভূমি, শুষ্ক এলাকাজলাশয়, পুকুর, নদীর পাড়
খাদ্যতৃণভোজী (পাতা, গাছ)মাংসাশী (ডিম, ছোট প্রাণী, মৃতদেহ)
লেজছোট, মোটা ও কাঁটাযুক্তদীর্ঘ, সরু ও মসৃণ
শরীরমোটা ও খসখসেদীর্ঘ ও মসৃণ
ইসলামি অবস্থানহালাল বা মুবাহ (মতভেদসহ)অধিকাংশ আলেম হারাম বলেছেন
বাংলাদেশে পাওয়া যায়?খুবই বিরলপ্রচুর পরিমাণে

গুইসাপ খাওয়া ইসলামি শরিয়তে হারাম কেন?

  • গুইসাপ মাংসাশী ও মৃতদেহভোজী প্রাণী।

  • এটি নাপাক ও ঘৃণিত জিনিস খায় বলে আলেমরা একে হারাম ঘোষণা করেছেন।

  • হাদীসে সরাসরি গুইসাপ খাওয়ার কথা উল্লেখ নেই, তবে এর স্বভাবের কারণে অধিকাংশ আলেম হারাম বলেছেন।

 

সান্ডার তেল বা “সান্ডা তেল” এর ব্যবহার

বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানে “সান্ডা তেল” নামে একটি জনপ্রিয় আয়ুর্বেদিক তেল রয়েছে, যা পুরুষদের যৌন শক্তি বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়।

এটি কীভাবে তৈরি হয়?

সান্ডা নামক প্রাণীটি মেরে তার তেল বের করে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।

⚠️ সতর্কতা:

  • এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়

  • ভুয়া তেলের ব্যবসা অনেক বেশি

  • শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে

ইসলামি দৃষ্টিকোণ:

  • প্রাণী হত্যার মাধ্যমে তৈরি হওয়ায় ফিকাহ অনুযায়ী বিতর্ক রয়েছে

  • নির্ভরযোগ্য উৎস না হলে ব্যবহার করা উচিত নয়

 

সান্ডা তেলের উপকারিতা কী?

সান্ডা তেল দীর্ঘদিন ধরে আয়ুর্বেদিক ও ইউনানী চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি মূলত পুরুষদের যৌন শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক বলে দাবি করা হয়। বিশেষ করে পুরুষাঙ্গে মালিশ করলে এটি রক্তসঞ্চালন বাড়িয়ে দুর্বলতা দূর করতে পারে এবং যৌন ক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করে বলে মনে করা হয়। এছাড়াও গাঁটের ব্যথা, পেশির ক্লান্তি এবং হাড়ের সমস্যাতেও সান্ডা তেল প্রয়োগ করা হয়। অনেকেই এটিকে প্রাকৃতিক যৌন উদ্দীপক হিসেবে ব্যবহার করেন। তবে এই দাবিগুলোর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দুর্বল এবং বাজারে ভেজাল তেলের আধিক্য রয়েছে। তাই ব্যবহারের আগে পণ্যটি আসল কিনা যাচাই করা উচিত এবং চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করাই উত্তম।

সান্ডা নিয়ে সাধারণ ভুল ধারণা

১. সান্ডা মানেই গুইসাপ – ভুল। এগুলো আলাদা প্রজাতির প্রাণী
২. সান্ডা খেলে পুরুষত্ব শক্তি বাড়ে – বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন প্রচারণা
৩. সব আলেম সান্ডাকে হারাম বলেন – না, অনেক আলেম একে হালাল বলেন
৪. সান্ডা বাংলাদেশে পাওয়া যায় – প্রকৃত সান্ডা বিরল; সাধারণত দেখা যায়নি

কোন কোন দেশে সান্ডা খাওয়া হয়?

  • সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিশর, মরক্কো, লিবিয়া – সান্ডাকে হালাল মনে করে অনেকে খান

  • ভারতের রাজস্থান ও পাকিস্তানের বেলুচিস্তান – সান্ডা তেল বানাতে মেরে ফেলা হয়

  • বাংলাদেশ – মূলত গুইসাপ ধরা হয়, যা ইসলাম মতে হারাম

 

উপসংহার

সান্ডা একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির টিকটিকি জাতীয় প্রাণী, যা মূলত মরুভূমি অঞ্চলে দেখা যায়। এটি খাওয়া ইসলামি শরিয়তে হারাম নয়, বরং হালাল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে গুইসাপ সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রাণী এবং অধিকাংশ আলেম একে হারাম বলেছেন।

সান্ডা ও গুইসাপের মধ্যে পার্থক্য জানা খুব জরুরি, বিশেষ করে ধর্মীয় বিধান অনুসরণের জন্য। ভুয়া প্রচারণা ও ব্যবসার ফাঁদে পা না দিয়ে, ইসলামি জ্ঞান, বৈজ্ঞানিক তথ্য ও সচেতনতার মাধ্যমে এই বিষয়গুলো বুঝে নেওয়া উচিত।

সান্ডা খাওয়া কি হালাল?

সান্ডা খাওয়া ইসলামী শরীয়তে হারাম নয়, তবে অনেক আলেম এটিকে অপছন্দনীয় মনে করেন। কেউ খেলেও গুনাহগার হবেন না, তবে না খেললেও কোনো ক্ষতি নেই।

সান্ডা ও গুইসাপের মধ্যে পার্থক্য কী?

সান্ডা একটি মরুভূমির সরীসৃপ, যা মূলত শুকনা বালুকাময় অঞ্চলে বাস করে, গুইসাপ সাধারণত জলকাদা বা ভেজা স্থানে দেখা যায়। সান্ডার পিঠ মোটা ও শক্ত এবং এটি তুলনামূলক নিরীহ, যেখানে গুইসাপ তুলনায় আক্রমণাত্মক।

সান্ডা তেলের উপকারিতা কী?

সান্ডা তেল যৌন দুর্বলতা দূর করতে, পুরুষদের যৌন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং শারীরিক ক্লান্তি উপশমে সহায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি রক্তসঞ্চালন বাড়িয়ে বিশেষ অঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে বলে দাবি করা হয়। তবে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সীমিত এবং অনেক ভেজাল তেল বাজারে পাওয়া যায়, তাই সতর্কতা প্রয়োজন।

এডু ডেইলি ২৪

Education, News and Information-based portal

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *