মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে যে নববর্ষের শোভাযাত্রা বের হয় তার নাম আর মঙ্গল শোভাযাত্রা থাকছে না। ১১ এপ্রিল ২০২৫ (শুক্রবার) সকালে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানিয়েছেন চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল ইসলাম শেখ। শোভাযাত্রার নাম হচ্ছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পহেলা বৈশাখ ও বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উদযাপনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান, বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উদযাপনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও প্রো-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক এম. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উদযাপনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য-সচিব ও চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল ইসলাম শেখ, শোভাযাত্রার উপ-কমিটির সদস্য-সচিব অধ্যাপক এ এ এম কাওসার হাসান, প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ এবং কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি ও উপ-কমিটিসমূহের সদস্যবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ পহেলা বৈশাখে উৎসব মুখর বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। এটি দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং গুরুত্বাবহ বলে বিবেচিত হয়। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও চারুকলা অনুষদ পহেলা বৈশাখ ও বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উদযাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ উপলক্ষে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা আয়োজনের কাজ চলছে।
অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছরের শোভাযাত্রাটি হবে সর্ববৃহৎ, বর্ণাঢ্য ও জাঁকজমকপূর্ণ। শোভাযাত্রায় বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন জাতিসত্তার অংশগ্রহণ থাকবে। অন্যদিকে রবিবার বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চারুকলার বকুলতলায় থাকবে চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠান।
যা যা থাকছে আনন্দ শোভাযাত্রা আয়োজনে
এবার বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় থাকছে ৭টি বড় মোটিফ। সেখানে রয়েছে ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, মুগ্ধের পানির বোতল, কাঠের বাঘ, ইলিশ মাছ, পালকি, শান্তির পায়রা। মাঝারি মোটিফ রয়েছে ৭টি। সেখানে রয়েছে, সুলতানি ও মুঘোল আমলের মুখোশ ১০টি, রঙিন চরকি ২০টি, তালপাতার সেপাই ৮টি, তুহিন পাখি ৫টি, পাখা ৪টি, ঘোড়া ২০টি, লোকজ চিত্রাবলীর ক্যানভাস ১০০ ফুট।
ছোট মোটিফ রয়েছে ৭টি। সেখানে রয়েছে ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি ৮০টি, বাঘের মাথা ২০০টি, পলো ১০টি, মাছের চাই ৬টি, মাথাল ২০টি, লাঙল ৫টি, মাছের ডোলা ৫টি। এছাড়াও চারুকলার সম্মুখভাগের দেয়ালে আঁকা হয়েছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ির মোটিফ অবলম্বনে চিত্রাঙ্কন, জয়নুল শিশু নিকেতন দেয়াল সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী মাটির দেয়াল অঙ্কনরীতি অবলম্বনে চিত্রাঙ্কন।
তরমুজ ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘প্রতিরোধ ও অধ্যবসারে প্রতীক’। ইসরায়েলের দখলদারত্বের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও মূলত এটি তাদের পতাকা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর কারণ হলো, ফলটির বাইরের অংশের রঙ সবুজ। আর ভেতরের অংশগুলোর রঙ লাল, সাদা ও কালো। এ রঙগুলো ফিলিস্তিনের পতাকার রঙের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
এবারের শোভাযাত্রায় অন্যান্য মোটিফের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মুসলমানদের লড়াই ও সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে তাদের প্রতীক হিসেবে তরমুজের মোটিফ সামনে আনা হয়েছে।
শোভাযাত্রায় থাকবে ঐতিহ্যবাহী পিস্টন বাঁশি, বাংলা ঢোল ও করনেট বাঁশি সহযোগে ৩০ জন শিল্পীর সম্মিলিত বিন্যাসে দেশাত্মবোধক গান; চারুকলার অভ্যন্তরে নাগর দোলা, চরকি, পুতুল নাচ, বায়স্কোপ, বৈশাখী খাবারের দোকান। শোভাযাত্রার মুকুট থাকছে ৫ হাজার। শোভাযাত্রার ব্যানার হবে একটি। যার আকার হবে ২৫ ফুট বাই ৩ দশমিক ৫ ফুট। পহেলা বৈশাখের দ্বিতীয় দিন চারুকলার বকুলতলায় রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে যাত্রাপালা।
মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের আয়োজনে বের হয় এই শোভাযাত্রা। একটি প্রতিপাদ্যকে উপজীব্য করে সাজানো হয় আয়োজন। প্রতি বছর প্রতিপাদ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই চারুকলার শিক্ষার্থীরা তৈরি করেন নানান মুখোশ, মূর্তি, ট্যাপা পুতুল, নকশি পাখি ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। যা ঐতিহ্যবাহী এই শোভাযাত্রাকে করে তোলে আকর্ষণীয় ও বর্ণিল।
শুরুর দিকে এই আয়োজনের নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রায় বদলে যায়। বর্ষবরণ উপলক্ষে ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় প্রথমবারের মত আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হলেও এর ইতিহাস আরো কয়েক বছরের পুরানো। ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। সেখানে ছিল- পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যযন্ত্রসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরের সেই শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। পরবর্তীতে যশোরের শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণের আনন্দ শোভাযাত্রা।
শোভাযাত্রার বিশ্ব স্বীকৃতি
বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনের ভিত্তিতে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জাতিসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায়।