মনে মনে পড়াশোনার গুরুত্ব

পাঠ্যবই, গল্পের বই, সংবাদপত্র কিংবা এ ধরনের যেকোনো শিক্ষনীয় লেখা পড়লে জানার পরিধি বাড়ে। শিক্ষাজীবনে যতো বেশি পড়া যায় ততোই ভালো। পড়া বা পাঠ সাধারণত দুই রকমের হয়- সরব ও নীরব; শব্দ করে জোরে জোরে অথবা মনে মনে নীরবে । সাধারনত ছোট বয়সে কিংবা বিশেষ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা জোরে বা শব্দ করে পড়ে। কিছু বিষয় অাছে, যেগুলো শব্দ করে পড়লে বা শুনলে মনে থাকে। আর কিছু বিষয় আছে বুঝে মনে মনে পড়তে হয়। মনে মনে পড়াশোনার গুরুত্ব কেন, তা জানা জরুরী।
শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের কিছু কিছু অংশে নীরবে পড়ার উপযোগী কিছু কিছু অংশ দেখা যায়। এছাড়াও আমাদের অনেক বড় বড় লেসন থাকে বিভিন্ন বিষয়ে যেমন বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল, পৌরনীতি ইত্যাদি। প্রতিটি বিষয়ই আমরা কি শব্দ করে পড়ব না জোরে জোরে পড়ব না কি নীরবে পড়ব? শিশু এবং প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই শব্দ করে কিছু পড়ে, কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথেই তারা নীরবে পড়তে শুরু করে। এটি কেন? মাধ্যমিক পর্যায়ে আমরা কি করব? শিক্ষার্থীদের নীরবে পড়তে বলব নাকি জোরে জোরে পড়তে বলব? শ্রেণিকক্ষে তাদের পড়াটা কেমন হবে? জোরে জোরে নাকি নীরবে?
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে নীরব পাঠ শিÿার্থীদের একা পড়ার দÿতা বৃদ্ধি করে। তাদেরকে পাঠে অধিক মনোযোগী হতে সাহায্য করে। কোন কিছু পাঠ করে তা থেকে মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারনা পাওয়াা জন্য নীর পাঠ প্রয়োজন।
চারদিকে যখন কোলাহল তখন কোন কিছু পাঠ করলে অনেক শিক্ষার্থী তাতে মনোযোগ দিতে পারেনা । নীরব পাঠ তাদেরকে কোন বিষয়বস্ত‘র ভেতরে প্রবেশ করার সুযোগ দান করে। তাই শ্রেণি কক্ষে শিক্ষার্থীদের শব্দ করে পড়ার পাশাপাশি নীরবে পড়তে দিতে হয়। ক্যাডেট কলেজসহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ’সেলফ স্টাডি’ বা ‘নিজে নিজে পড়াশোনা’ পদ্ধতি চালু আছে। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে নিজেরা পড়াশোনা করে এবং শিক্ষকরা কেবল তদারকি করেন। সিভিল প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কোন বিষয় সাধারনত নেই। কিন্তু সিভিল ও অনাবাসিক শিÿা প্রতিষ্ঠানেও মাঝে মাঝে এ ধরনের সেশন অর্থাৎ নীরবে পড়ার বা ’ সেলফ-স্টাডি’ সেশন থাকা দরকার। যেমন পরীÿার ক’দিন আগের ক্লাসগুলোতে এ ধরনের পাঠ থাকলে শিÿক ও শিÿার্থী উভয় পÿই সময়টুকা কাজে লাগাতে পারে। শব্দ করে শিক্ষক যখন কোন কিছু হয়তো কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীদের বুঝাচেছন, দেখা যাবে ঐসব বিষয়টি বেশ কিছু শিÿার্থী ইতিমধ্যে বেশ ভাল করেই বুঝেছে এবং পড়েছে। পরীÿার পূর্বে শ্রেণিকক্ষে কোনো কিছু সশব্দে কোন করা তাদের জন্য সময় নষ্ট হওয়া। আর এটি তো প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, আমাদের শ্রেণিকক্ষগুলো ’ মিক্সড অ্যাবিলিটি’র শিÿার্থী দিয়ে ভর্তি থাকে। তাই সশব্দে সব সময়ই সবকিছু করা হলে তা সবার জন্য মঙ্গলজনক নাও হতে পারে। শিক্ষার্থীদের মাঝে মাঝে নীরবে পড়তে দিলে কিংবা ’সেলফ-স্টাডি’ দিলে শিÿার্থীরা তাদের নিজের মতো করে সময়টুকু কাজে লাগাতে পারে।
শিক্ষার্থীরা যখন নীরবে কোন কিছু পড়ে তখন তারা যে বিষয়টি পড়ছে তাদের মনের মধ্যে তার একটি ছবি এঁকে ফেলে, ফলে সেই পাঠ এবং পাঠের বিষয়বস্ত‘ দীর্ঘস্থায়ীভবে মনে স্থান পায়। ক্লাসে একজন শিক্ষক একইভাবে কোন বিষয় লেকচারের মাধ্যমে বুঝিয়ে থাকেন যা এক এক শিক্ষার্থী একেকভাবে বুঝে এবং বুঝতে সময় নেয়। তাই যখন তারা নীরবে ঐ বিষয়টি পড়ে তখন তারা বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করতে পারে। আর যখনই সে গভীরে প্রবেশ করে তখন সে নতুন এক ধরনের আনন্দ পায়, তার বোধগম্যতা বা আন্ডাাস্ট্যান্ডিং ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি পায়। সে বিষয়ের ভেতর নতুন কিছু আবিষ্কার করে। তার এই আনন্দ, বোধগম্যতা এবং নতুন আবিস্কার তাকে অনেকদুর এগিয়ে নিয়ে যায়।
নীরব পাঠ শিক্ষার্থীদের বোধগম্যতা বৃদ্ধি করে কারন নীরব পাঠ কোন বিষয়ে গভীরে প্রবেশ করতে এবং অধিকতর মনোযোগ দিতে সহায়তা করে। কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে কোন কিছু পড়ার যে দÿতা তা বৃদ্ধি করে এই নীরব পাঠ।এর কারণ হচেছ পড়ার মূল ফোকাস থাকে তখন বিষয়বস্তুটি যাতে বুঝা যায় তার দিকে, শব্দের উচচারণের দিকে নয় যেটি শব্দ করে মুখে পড়ার ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। তাছাড়া দ্রুত কোন কিছু পড়ার ক্ষেত্রেও নীরব পাঠ আমাদের সাহায্য করে। বিভিন্ন শব্দের মধ্যে সম্পর্ক এবং সংযোগ স্থাপিত হয় এই নীরব পাঠের মাধ্যমে। আমরা যা কিছুই পড়ি তা হজম করতে এবং তথ্যের সন্নিবেশ ঘটাতে অর্থাৎ বিষয়বস্তুটি আত্মস্থ করতে কিছু সময় এবং কিছু নীরবতার দরকার, নীরব পাঠ আমাদের সে সুযোগটি করে দেয়।
জোরে জোরে কিংবা শব্দ করে পড়া পাঠককে ছাপানো পৃষ্ঠা থেকে চিন্তর খোরাক জোগায় আর নীরব পাঠক তা সরাসরি গ্রহন করেন তার পাঠ থেকে। মৌখিক পাঠ একটি জটিল পদ্ধতি কারণ এখানে মানসিক ব্যাপার আছে ,মানসিক ব্যাখ্যা আছে যেগুলো নির্ভর করে বইয়ের ওপর চোখ দ্রুত বোলানো এবং কন্ঠস্ত^রের ওঠা নামার ওপর। নীরব পাঠক বার বার একই পাঠের ওপর চোখ বোলাতে পারেন ফলে পাঠের বিষয়বস্ত‘ সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। মৌখিক পাঠক অর্থাৎ শব্দ করে যিনি পাঠ করেন তিনি অধিকতর জোর দিয়ে থাকেন শব্দের উচ্চারণের প্রতি আর নীরব পাঠক ব্যস্তÍ থাকেন পাঠের মর্মেদ্ধারে আর মূলত আমরা এজন্যই কোন কিছু পড়ে থাকি।

কিছু কিছু শিক্ষক আছেন যারা ক্লাসকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করেন এবং শিক্ষার্থীদের সুযোগ করে দেন তারা যেসব বিষয় পড়েছে সেগুলো এক অপরের সাথে আলোচনা করতে । আবার কিছু কিছু ক্লাসে শিক্ষক জুটিতে কাজ করতে দেন সেখানে একজন সহপাঠী অন্যজনের সাথে শেয়ার করতে পারে সে কোন বিষয়টি নীরবে পড়ে ফেলেছে এবং সেখান থেকে কি কি শিখেছে। অর্থাৎ কোন কিছু প্রথমে একটি নির্দিষ্ট সময় যাবৎ নীরবে পড়তে দিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য বা আলোচনা করার জন্য এ ধরনের গ্রæপ বা পেয়ারে কাজ করতে দিতে পারেন।
শব্দ করে কোন কিছু পাঠ করা প্রথমদিকের ব্যাপার, এটি তখন গুরæত্বপূর্ন। আর নীরব পাঠ জীবনব্যাপী উপকারী এবং প্রয়োজনীয়। উচচমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নীরব পাঠই আমরা করে থাকি।এটি আসলে একটি দক্ষতা যা এই পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অর্জন করতেই হয় তবে এর প্রাকটিস শুরু করতে হয় মাধ্যমিক পর্যায় থেকে। শিক্ষার্থীদের যখন নীরবে কোন কিছু পাঠ করতে দেব তখন আমরা শিক্ষক হিসেবে কি ভূমিকা পালন করব? আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে কোন শিক্ষার্থী কি করছে।কোন কোন শিক্ষার্থী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নীরবে তাদের পাঠ পড়ে বুঝতে পারে আবার কিছু কিছু শিক্ষার্থী অনেক কষ্ট করে একটি বিষয় বুঝতে চেষ্টা করে। তখন তাদের কাছে গিয়ে ব্যাক্তিগত সহায়তা প্রদান করা আমাদের কাজ হবে।
অনেক সময় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী এবং অফিসের কর্মকর্তাদের অনেক জটিল বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতে হয়। সেসব জটিল বিষয়াদি মাথার মধ্যে ঢোকাতে তারা নীরব পাঠের আশ্রয় নেন। তার অর্থ কি? কোন কিছুর গভীরে প্রবেশ করতে হলে নীরবে পাঠ করতে হয়। শিক্ষার্থীদের এই অভ্যাস মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই প্রাকটিস করতে হয়।
বাস্তব জীবনে আমরা প্রকৃতিকভাবেই নীরব পাঠক। আমরা যখন কফিশপে যাই, হোটেল-রেষ্টুরেন্টে যাই তখন খাবার মেন্যু পছন্দ করি লিষ্ট দেখে। সেই লিস্ট বা মেন্যু কি আমরা জোরে জোরে পড়ি? আমরা পাবলিক পরিবহনে উঠে অনেক নিয়ম-কানুন ও আইনগত বিষয়াদি পড়ে থাকি, সেগুলো কিভাবে পড়ি? অবশ্যই নীরবে ।কারণ আমরা আমাদের চারপাশের লোকদের বিরক্ত করতে চাইনা, আর খুব ভালভাবে বুঝার জন্য আমরা নীরবে পড়াটাকেই শ্রেয় মনে করি। আমরা প্রতিদিন সংবাদপত্র পড়ে থাকি, কিভাবে পড়ি? নীরবে পড়ি। সংবাদপত্র, গল্প উপন্যাস এগুলো আমরা নীরবে পড়ে থাকি। আমরা মিশে যাই গল্পের ঘটনার সাথে, উপন্যাসের নায়ক নায়িকার সাথে। তাদের ব্যাথায় ব্যাথিত হই, তাদের সুখে ও আনন্দে উৎফুল্ল হই, ঘটনার সাথে সাথে আমরা উত্তেজিত হই, আমাদের রিঅ্যাকশন প্রকাশ করি। আমরা নীরবে পাঠ করি বলে বিষয়গুলোর গভীরে যেতে পারি এবং সেগুলোর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে পারি।
যে কোন ধরনের পরীক্ষার কথা যদি মনে করি তাহলে আমরা কি দেখি? প্রশ্নপত্র সবাই নীরবে পাঠ করছে।পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র যদি সবাই জোরে জোরে পড়া শুরæ করে তাহলে কি হবে? একটি বিরক্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হবে যেখানে কেই আর পরীÿায় মনোনিবেশ করতে পারবেনা। বাস্তব অবস্থা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, বয়স আমাদের কোনোকিছু নীরবে পড়তে বলে আর প্রকৃতগতভাবে বেশিরভাগ পাঠই আমরা নীরবে করে থাকি। নীরব পাঠের অভ্যাস আমাদের মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই শুরু করতে হবে। কিভাবে এটিকে কার্যকরী করা যায় শিক্ষক সে বিষয়ে শিক্ষার্থীদের উপদেশ দিবেন এবং প্রাকটিস করাবেন। তবে উচচারণ শেখানোর জন্য অবশ্যই শব্দ করে অর্থাৎ জোরে জোরে কোন কিছু পড়তে দিতে হবে, এটি অবশ্য প্রথমদিকের ব্যাপার। বয়স বাড়ার সাথে আমাদের পাঠ্যাভাসে যে পরিবর্তন দেখা দেয়, নীরব পাঠ তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ন অনুসঙ্গ।
লেখক : মুহম্মদ মাছুম বিল্লাহ, সাবেক অধ্যাপক: সিলেট, কুমিল্লা, মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ এবং রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ