বাদশাহ আওরঙ্গজেব : মুঘল সম্রাট হয়েও টুপি সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন

বাদশাহ আওরঙ্গজেব : মুঘল সম্রাট হয়েও টুপি সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন

বাদশাহ আওরঙ্গজেব তখন পাঞ্জাবের হসন আব্দাল শহরে অবস্থান করছিলেন। রাজবাড়ির দেওয়ালের বাইরে ছিল এক দরিদ্র বৃদ্ধের ছোট্ট আটা-চাকির দোকান। রাজবাগানের ভেতর দিয়ে যে ঝরনার পানি বাইরে নালায় গিয়েছিল, সেই পানির স্রোতেই তার যাঁতা ঘুরতো। এইভাবে আটা পিষে সে বাজারে বিক্রি করতো, আর সেই সামান্য আয়ে তার সংসার চলতো।

কিন্তু বাদশাহর আগমনের সময় নাজীরের চাকররা সেই পানির রাস্তা বন্ধ করে দেয়। যাঁতা থেমে যায়, আয়ের রাস্তা বন্ধ হয়ে বৃদ্ধ প্রায় অনাহারে মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকে। খবর পৌঁছে যায় মাসিরে আলমগিরির লেখক সাকী মুস্তাদ খাঁর কানে। তিনি বখ্তাত্তর খাঁ নামের এক উচ্চপদস্থ কর্মচারীর মাধ্যমে বিষয়টি বাদশাহকে জানান।

আওরঙ্গজেব সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দেন—“যাও, গিয়ে নিজে দেখো। পানির রাস্তা খুলে দাও, আর যারা এই অন্যায় করেছে তাদের কড়া করে সাবধান করো। যেন আর কখনো বৃদ্ধের জীবিকার পথে বাধা না আসে।”

রাত গভীর হলে বাদশাহ নিজে দেড় প্রহরে দুই থালা খাবার আর পাঁচটি মোহর পাঠালেন। কর্মচারীর হাতে দিয়ে বললেন—“বখ্তাত্তর খাঁর কাছে যাও, উনি তোমাকে বুড়োর কুঁড়েঘরের পথ দেখিয়ে দেবেন। বুড়োকে আমার সালাম জানাবে, আর আমার পক্ষ থেকে বলবে—‘তুমি আমার প্রতিবেশী, অথচ আমার কারণে কষ্ট পেয়েছো। আমাকে ক্ষমা করো।”


কর্মচারী সেই অন্ধকার রাতে পাহাড় টপকে বুড়োর ঘরে পৌঁছাল। দরজা খুলে বৃদ্ধকে জাগাল, বাদশাহর বার্তা পৌঁছে দিল। বুড়োর চোখে জল এল, সে ক্ষমা করে দিল বাদশাহকে। পরদিন ভোরে আওরঙ্গজেব নির্দেশ দিলেন—“রাজপালকীতে বুড়োকে নিয়ে এসো।”

যে মানুষ কোনোদিন পালকীর নামও শোনেনি, তাকে বসানো হলো রূপার ডাঁটা লাগানো রাজপালকীতে। রাজপ্রাসাদে এনে বাদশাহ তার খোঁজখবর নিলেন। জানা গেল, তার স্ত্রী, দুই অবিবাহিতা কন্যা ও দুই নগ্নপুত্র আছে। বাদশাহ রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডার থেকে তাকে দিলেন দুই শত টাকা। বেগমরা দিলেন গহনা, পোশাক, অর্থ। দুদিন প্রাসাদে থাকার পর যখন বুড়ো ঘরে ফিরল, তখন তার পরনে শাল, দামি জামা, সোনালি কারুকাজের টুপি, কোমরে ঝোলানো মোহর আর গহনা।

মুখশ্রী শুকনো চামড়ায় ঢাকা, চোখ প্রায় অন্ধ, তবু সে যেন নতুন জীবন পেল। মুস্তাদ খাঁ তাঁবুর সামনে এসে দাঁড়ালে বুড়ো কাঁপা গলায় বলল—“আব্বা, আমি সেই বুড়ো। আপনার এবং বখ্তাত্তর খাঁর অনুগ্রহে আজ আমার এই সৌভাগ্য।” খাঁ হাত তুলে দোয়া করলেন—“আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন।”

দু-তিন দিন পরে বাদশাহ আবার ডেকে পাঠালেন বুড়ো ও তার কন্যাদের। তাদের বিয়ের জন্য দিলেন হাজার টাকা যৌতুক, বেগমরা দিলেন পোশাক-গহনা। বুড়োর জন্য নতুন যাঁতা বসানো হলো, সরকারি বাগান থেকে জল সরবরাহের ব্যবস্থা হলো। সব করমুক্তির সনদও দেওয়া হলো। রাজবৈদ্য তার চোখের চিকিৎসা করলেন। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেল, উলঙ্গ ছেলেরা পরল জরীর পোশাক।

বৃদ্ধার স্ত্রীর দিকে কেউ তাকাতো না, গ্রামে তাকে বলা হতো বুড়ি ডাইনী। কিন্তু বাদশাহর অনুগ্রহে তারও রূপ যেন ফিরে এল, লোলচর্ম মুছে গেল, চোখে জ্যোতি এলো। সে যেন আবার তরুণী হয়ে উঠল। এভাবেই আওরঙ্গজেব শুধু রাজ্য নয়, এক অসহায় পরিবারের ভাগ্যও বদলে দিয়েছিলেন—দরিদ্রের জীবনে দান করেছিলেন সম্মান, নিরাপত্তা আর আশার আলো।

Rate This Article

How would you rate this article?

Edu Daily 24
Edu Daily 24

Experienced writer with deep knowledge in their field.

Our Editorial Standards

We are committed to providing accurate, well-researched, and trustworthy content.

Fact-Checked

This article has been thoroughly fact-checked by our editorial team.

Expert Review

Reviewed by subject matter experts for accuracy and completeness.

Regularly Updated

We regularly update our content to ensure it remains current.

Unbiased Coverage

We strive to present balanced information.