ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে গাজীপুরে বেড়েছে গরু চুরির হিড়িক
নির্ঘুম রাত কাটছে কৃষক-খামারিদের

এ এইচ সবুজ, গাজীপুর: কদিন বাদেই পবিত্র ঈদুল আজহা। আর এই পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে গাজীপুরের শ্রীপুর ও কাপাসিয়ায় গরু চুরির হিড়িক পড়েছে। গত এক সপ্তাহে দুই উপজেলায় কৃষক ও খামারির ২৩টি গরু চুরি হয়েছে। প্রতি রাতেই সংঘবদ্ধ চোরের দল কোন না কোন কৃষক ও খামারির বাড়িতে হানা দিচ্ছে। এতে আতঙ্কে রয়েছেন খামারি ও কৃষকরা।
গরু রক্ষার জন্য কেউ কেউ গোয়াল ঘরেই রাত পার করছেন। এছাড়াও চুরি ঠেকাতে কোন কোন পাড়া মহল্লায় রাত জেগে পাহারার ব্যবস্থা করেছে গ্রামবাসী।প্রতি রাতে গরু চুরির ঘটনা ঘটলেও পুলিশের তৎপরতা নেই বলে দাবি করছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও খামারিরা। থানায় অভিযোগ দিয়েও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
বুধবার (২৮ মে) রাত সাড়ে তিনটার দিকে শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা ইউনিয়নের হায়াতখারচালা (শরীফ বাজার) গ্রামের ইউসুফ আলী প্রধানের বাড়িতে গরু চুরির ঘটনা ঘটে। চোরের দল কেয়ারটেকার ও তার স্ত্রীর মুখে চেতনানাশক ছিটিয়ে কোরবানির একটি ষাঁড়সহ পাঁচটি গরু চুরি করে নিয়ে যায়।
একই দিন দিবাগত রাতে কাপাসিয়া উপজেলার রাউৎকোনা গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলামের গোয়াল ঘর থেকে আরও তিনটি গাভি চুরি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শ্রীপুর ও কাপাসিয়ায় কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে কিছু লাভের আশায় কেউ ৩-৪টি আবার অনেকে আরও বেশি করে গরু লালন-পালন করেছেন। সম্প্রতি গরু চোরের উপদ্রব বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। প্রতি রাতেই কারো না কারো বাড়িতে গরু চুরির ঘটনা ঘটছে। তবে পুলিশ বলছে, তাদের অভিযোগ সঠিক নয়। প্রতি রাতেই পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় পাহারা দিচ্ছে।
এর আগে, মঙ্গলবার (২৭ মে) কাপাসিয়া উপজেলার কান্দানিয়া গ্রামের মনো মিয়ার গোয়াল ঘর থেকে দুই লাখ টাকা মূল্যের একটি গরু চুরি হয়ে যায়।
সোমবার (২৬ মে) উপজেলার কপালেশ্বর গ্রামের কৃষক আলম মিয়ার ৩০ হাজার টাকা মূল্যের একটি ষাঁড়, নুরুল ইসলামের দেড় লাখ টাকা মূল্যের একটি গাভি এবং বিল্লাল মিয়ার গোয়াল ঘরে থেকে তিন লাখ টাকা মূল্যের দুইটি গাভি চুরি হয়।
একই রাতে উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের বামনখলা গ্রামের কৃষক আবুল কাশেম সিকদারের গোয়াল ঘর থেকে দুইটি গাভি, পাশের নবীপুর গ্রামের ছলিম উদ্দিনের গোয়াল ঘর থেকে দুইটি গরু চুরি হয়।
এরও আগে, বুধবার (২১ মে) ভোর রাতে শ্রীপুর পৌরসভার লোহাগাছ (সাত রাস্তা ও বহেরাতলী) এলাকায় এক রাতে তিন কৃষক আসাদ মিয়া, খোরশেদ মিয়া ও কাঞ্চন মিয়ার সাতটি গরু চুরির ঘটনা ঘটে। রাত ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে চোরের দল গোয়াল ঘর থেকে গরু চুরি করে নিয়ে যাওয়ায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
পৌরসভার লোহাগাছ (সাত রাস্তা মোড়) এলাকার কৃষক খোরশেদ মিয়ার গোয়াল ঘর থেকে একটি দুধেল গাভি, একটি বকনা এবং একটি বাছুর চুরি করে নিয়ে যায়। চুরি হওয়া গরুর বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় আড়াই লাখ টাকা। একই রাতে পাশের আসাদ মিয়ার গোয়াল ঘর থেকে একটি গর্ভবতী গাভি এবং একটি বকনা বাছুর চুরি হয়ে যায়। চুরি হওয়া গাভি ও বকনার বাজার মূল্য প্রায় দুই লাখ টাকা। ওই রাতেই লোহাগাছ (বহেরাতুলী) এলাকার কাঞ্চন মিয়ার গোয়াল ঘরের তালা কেটে দুটি গরু চুরি করে নেয় চোরের দল। যার বাজার মূল্য দুই লাখ টাকা।
কৃষক আসাদ মিয়া বলেন, রাত সাড়ে ৩টার দিকে হঠাৎ গাড়ির আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। ঘর থেকে বের হয়ে গোয়াল ঘরে গিয়ে দেখি গর্ভবতী গাভি এবং একটি বকনা বাছুর নেই। আমার চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সড়কে গাড়ির শব্দ পেলেও তারা চোরের গাড়ি ধরতে পারেনি।
ক্ষতিগ্রস্থ অপর কৃষক কাঞ্চন মিয়া এবং খোরশেদ মিয়ার বলেন, সংঘবদ্ধ চোরের দল গভীর রাত ৩টার পর থেকে গরুগুলো চুরি করে নিয়ে যায়। পুলিশ একটু তৎপর হলেই চুরি হওয়া গরু উদ্ধার এবং চোর চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।
ইউসুফ আলী প্রধান নামের এক ভুক্তভোগী জানান, তিনি ঢাকায় বসবাস করেন। বাড়িতে গরু লালন-পালনের জন্য কেয়ারটেকার কুরবান আলীকে নিয়োগ করা হয়েছে। কেয়ারটেকার ও তার স্ত্রী গোয়াল ঘরের পাশের কক্ষে থাকেন। তাদের ছেলে হামিদুল ইসলাম বাড়ির মালিকের অপর একটি ঘরে থাকেন। রাতে দুটি ষাঁড়, একটি গাভি ও দুটি বাছুর চুরি হয়। চুরি হওয়া পাঁচটি গরুর আনুমানিক মূল্য সাড়ে ছয় লাখ টাকা।
তিনি আরো জানান, ছয় মাস আগেও তার গোয়ালঘর থেকে গরু চুরির ঘটনা ঘটেছিল। থানায় অভিযোগ দিলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার অথবা গরু উদ্ধার করতে পারেনি। চুরি হওয়া গরু উদ্ধারে পুলিশের তেমন উৎসাহ না থাকায় কৃষক ও খামারিরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।
কেয়ারটেকার কুরবান আলীর জানান, ঘটনার রাতে শব্দ পেয়ে ঘর থেকে দা হাতে বেরিয়ে আসেন তার স্ত্রী। দুই-তিনজন লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পান। এসময় দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের মধ্য থেকে একজন তার স্ত্রীর মুখে চেতনানাশক ছিটিয়ে দিলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে তিনি (কুরবান আলী) বাইরে এলে চোর দলের সদস্যরা তার মুখেও চেতনানাশক ছিটিয়ে দিলে তিনিও অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তাদের ছেলে হামিদুল ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখেন উঠানে অচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছেন মা-বাবা। গোয়াল ঘরের দরজা খোলা দেখে এগিয়ে দেখেন পাঁচটি গরুর একটি গরুও নেই। পরে তার বাবা-মাকে শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসার পর তাদের জ্ঞান ফেরে।
স্থানীয়রা বলছেন, এলাকায় আশঙ্কাজনকভাবে গরু চুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষক ও খামারিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক খামারি ও কৃষক রাত জেগে তাদের গোয়ালঘর পাহারা দিচ্ছেন।
ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক বিল্লাল মিয়া ও নুরুল ইসলাম বলেন, গভীর রাত ২টা থেকে ভোর ৫টার মধ্যে এসব চুরি সংঘটিত হয়। চুরির ঘটনায় মামলা করিনি।
কাপাসিয়া উপজেলার পাবুর গ্রামের খামারি শাকিল হাসান মোড়ল বলেন, কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে গরু চুরি বেড়েছে। আমার খামারে ১০ লাখ টাকা মূল্যের গরু নিয়ে আতঙ্কে রাত পার করেছি।
শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহম্মদ আব্দুল বারিক বলেন, কোনো খামারি বা কৃষক থানায় অভিযোগ দেয়নি। তবে গরু চুরির বিষয়ে শুনেছি। আমরা গরু চুরি রোধে টহল বাড়িয়েছি এবং কয়েকজন চোরের নাম ঠিকানা আছে আমাদের কাছে। তাদের ধরতে পারলেই ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক এবং খামারিরা অভিযোগ না দিলেও আমি তাদের বাসায় গিয়ে মামলা নেব।
এ বিষয়ে কাপাসিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জয়নাল আবেদীন মণ্ডল বলেন, গরু চুরির বিষয়ে আমাকে এখনও কেউ জানায়নি। আপনাদের (সাংবাদিক) মাধ্যমেই জানলাম। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখব।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি দিনের বেলায় কাপাসিয়া থেকে গরু চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় জনতা পাঁচ গরু চোরকে হাতেনাতে আটক করে। আটককৃত পাঁচ জনকে মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।