Table of Contents
ব্যর্থতার গল্প
তন্ময় হালদারের জীবনের শুরুতে পাওয়া অভিজ্ঞতাই তাকে শিখিয়েছে ব্যর্থতা মানেই শেষ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় একের পর এক চেষ্টা করেও যখন কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হলো না, তখন তিনি বুঝলেন পথটা সহজ হবে না। অনেকটা ভগ্নহৃদয় হয়েই ভর্তি হলেন তেজগাঁও কলেজে।মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তন্ময় জানতেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সামর্থ্য নেই। তাই স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে বেছে নিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত তেজগাঁও কলেজের বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিষয়টি। প্রথম দিকে অনেকেই তার সিদ্ধান্তকে ছোট করে দেখলেও তিনি হাল ছাড়েননি। ধীরে ধীরে সেই ব্যর্থতার গল্পই তাকে গড়ে তোলে আরও দৃঢ়, আরও স্থিরপ্রতিজ্ঞ একজন শিক্ষার্থী হিসেবে।
কলেজ জীবন যেভাবে কাটিয়েছেন
তন্ময় কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকটা তার জন্য খুব একটা সহজ ছিল না। প্রথমে বিষয়টি (বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি) নিয়ে খুব বেশি ধারণা ছিল না, ক্লাসেও নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন না। পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্কটা যেন একটু দূরত্বে থেকেই যাচ্ছিল।তবে ধীরে ধীরে ভেতরে ভেতরে একটা পরিবর্তন আসতে শুরু করে। মোবাইল ফোনে নানা তথ্য ঘাঁটতে ঘাঁটতে বিদেশে পড়াশোনা ও গবেষণার সুযোগ সম্পর্কে জানতে পারেন তিনি। সেই মুহূর্তে তার মনে দাগ কাটে একটি স্বপ্ন—“একদিন আমি পিএইচডি করব, উন্নত শিক্ষার জন্য বিদেশে যাব।”
সেই স্বপ্নই হয়ে ওঠে পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার মূল অনুপ্রেরণা। ধীরে ধীরে ক্লাসে নিয়মিত হওয়া, বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করা এবং ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা শুরু করেন তন্ময়।বাইরে যাওয়ার প্রবণতা আর ইচ্ছে তাকে পড়াশোনায় মনোযোগী করে তোলে।
আবেদন প্রক্রিয়া যেমন ছিল
তন্ময়ের আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল যখন তিনি ঠিক করলেন বিদেশে পড়াশোনা করবেন। তিনি জানতেন, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে শতভাগ পেমেন্ট দিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করা খুবই কঠিন। তাই প্রথমেই লক্ষ্য স্থির করলেন ইউরোপের দেশগুলো।তিনি ট্রাভেল খুব পছন্দ করেন, তাই ইউরোপ তার জন্য আকর্ষণীয় জায়গা ছিল। এরপর তিনি ধাপে ধাপে নিজের বিষয়ভিত্তিক অপশনগুলো খুঁজতে শুরু করেন। কোন বিশ্ববিদ্যালয় কী অফার করছে, কোথায় তার বিষয় অনুযায়ী সুযোগ আছে, সবকিছু লিস্ট করে রাখতেন। প্রক্রিয়াটিকে আরও কার্যকর করতে তিনি নোট তৈরি করতেন, প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও যোগ্যতা কীভাবে শক্তিশালী করা যায় তা চিন্তাভাবনা করতেন। ইউটিউব, গুগল এবং বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে খোঁজ চালিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রোগ্রাম সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করতেন। এই ধাপে ধাপে গবেষণার মাধ্যমেই তিনি নিজের আবেদন প্রস্তুত করেন এবং প্রক্রিয়াটিকে সুসংগঠিত ও পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যান।
ভর্তির ক্ষেত্রে যে দিকগুলো অগ্রাধিকার দিয়েছেন
ভর্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন প্রোগ্রামের সাথে আপনার প্রোফাইলের সামঞ্জস্য করে। তার মতে , “CGPA কম থাকলে বা GPA কম থাকলে তা বড় বিষয় নয়। মূল কথা হলো, আপনার প্রোফাইল এবং প্রোগ্রামের মধ্যে কতটা মিল আছে।”
তিনি তার প্রোফাইলকে আরও শক্তিশালী করার জন্য তার গবেষণা অভিজ্ঞতা, স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম এবং প্রকাশিত আর্টিকেলগুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ভর্তির জন্য সাধারণত প্রয়োজনীয় ভাষা পরীক্ষা যেমন IELTS, TOEFL তন্ময় তা দেননি, বরং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া Medium of Instruction (MOI) সার্টিফিকেট জমা দিয়েছেন।যেখানে উল্লেখ ছিল যে তার সম্পূর্ণ পড়াশোনা ইংরেজি ভাষায় সম্পন্ন হয়েছে। এভাবেই বাড়তি খরচ ছাড়াই তিনি আবেদন সম্পন্ন করেন।
কম সিজিপিএ ও কলেজ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে
তন্ময় হালদার বিশ্বাস করেন, শিক্ষার্থীরা কখনোই নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে বড় বাধা বানিয়ে ফেলতে পারে না। তিনি বলেন, “আপনি কোন কলেজে পড়ছেন বা কোন সাবজেক্টে আছেন—এগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। ইউরোপে কেউ দেখবে না আপনি কোথা থেকে পড়েছেন। মূল বিষয় হলো, আপনি প্রোগ্রামের জন্য কতটা উপযুক্ত।”তন্ময় আরও যোগ করেন, “CGPA কেবল একটি নাম্বার। যদি আপনার লক্ষ্য আপনার পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তবে সিজিপি নিজেই ধীরে ধীরে বাড়বে। তাই হতাশা নয়, বরং আরও উদ্যমীভাবে পড়াশোনা করতে হবে।”
যদি কোনো ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকে, তা অন্য জায়গা দিয়ে পূরণ করতে হবে। তিনি উদাহরণ দেন “CGPA কম হলে নিজের গবেষণা দক্ষতা বাড়াতে হবে, রিসার্চ প্রপোজাল তৈরি করতে হবে, ভালো থিসিস করতে হবে। পাশাপাশি কো-কারিকুলার কার্যক্রমে মনোযোগ দিতে হবে। এইভাবে ঘাটতি পূরণ করলে নিজের প্রোফাইল আরও শক্তিশালী হয়।”
গবেষণা ও প্রকাশনা
তন্ময়ের ঝুলিতে রয়েছে দুই বছরের ল্যাবরেটরি ও গবেষণার অভিজ্ঞতা। এ সময়ে তিনি দুটি রিভিউ আর্টিকেল প্রকাশ করেছেন। যদিও এগুলো আন্তর্জাতিক ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে প্রকাশিত হয়নি, তবুও এগুলো তার একাডেমিক মনোভাব ও গবেষণা-সামর্থ্যের প্রমাণ হিসেবে কাজ করেছে।
সহপাঠ কার্যক্রম ও স্বেচ্ছাসেবা
কেবল পড়াশোনাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না তন্ময়। বিভিন্ন সহপাঠ কার্যক্রম ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কর্মকাণ্ডে তিনি নিয়মিত অংশ নিয়েছেন। তার ভাষায়, “ইরাসমাস মেধাবীদের পাশাপাশি বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ খোঁজে। তাই সমাজসেবায় অংশগ্রহণ কিংবা নেতৃত্বদানের অভিজ্ঞতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।”
সম্পূর্ণ নিজ প্রচেষ্টা
অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য কনসালটেন্সি বা এজেন্সির ওপর নির্ভর করেন। তন্ময় কিন্তু সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছেন। আবেদনপত্র লেখা, সুপারিশপত্র সংগ্রহ, প্রবন্ধ তৈরি—সবই করেছেন নিজে। তার এই সাহসী পদক্ষেপ প্রমাণ করে, আত্মবিশ্বাস আর ধৈর্য থাকলে কোনো কনসালটেন্সি ছাড়াই সফল হওয়া সম্ভব।
সাফল্যের দিন
অবশেষে সেই প্রতীক্ষার ফল মিলল। পূর্ণ অর্থায়নে ইরাসমাস মুণ্ডুস বৃত্তি পেলেন তন্ময় হালদার। মাস্টার্স প্রোগ্রামের মেয়াদ এক বছর হলেও তিনি পড়াশোনা করবেন ইউরোপের চারটি ভিন্ন দেশে। প্রতিটি দেশ নতুন অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার দিগন্ত খুলে দেবে তার জন্য। পড়াশোনার পাশাপাশি মাসিক ভাতা তাকে সহায়তা করবে জীবনযাত্রা নির্বাহে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
তন্ময় হালদারের মূল লক্ষ্য সবসময়ই ছিল গবেষণা। মাস্টার্স শেষ করার পর তিনি বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে চান ড্রাগ ডিজাইন বা ওষুধ আবিষ্কারের গবেষণায়। তার পরিবারে অনেকের চিকিৎসা না পাওয়ার কষ্ট, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা এবং সমাজে সাধারণ মানুষের ভোগান্তিই তাকে অনুপ্রাণিত করেছে এই ক্ষেত্র বেছে নিতে। তিনি বলেন, “ড্রাগ ডিজাইন খুব বড় একটি বিষয়। ইউরোপসহ উন্নত দেশে এ নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশে এখনো যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। অথচ আমাদের দেশে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ সাধারণ রোগে কিংবা ভাইরাসে মারা যায়। ডেঙ্গু তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা। তাই ডেঙ্গুর প্রতিষেধক আবিষ্কার নিয়েই আমার ভবিষ্যৎ গবেষণার ইচ্ছা।” মাস্টার্স শেষে এ বিষয়ে পিএইচডি করার পরিকল্পনা রয়েছে তন্ময়ের। তিনি বিশ্বাস করেন, উন্নত দেশের গবেষণাগারে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান একদিন দেশের মানুষের জীবন বাঁচাতে কাজে লাগবে।