খবর

ঢাকায় আইইএলটিএস প্রশ্নফাঁস চক্রের সন্ধান ডেইলি সানের রিপোর্টে

ঢাকায় আইইএলটিএস প্রশ্নফাঁস চক্রের সন্ধান ডেইলি সানের রিপোর্টে

শনিবার রাজধানীতে ৩৭ বছর বয়সী মো. মামুন খান ও তার সহযোগী পন্না পুনম হালদার ওরফে কেয়াকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা বহুদিন ধরে শিক্ষার্থীদের কাছে ফাঁস হওয়া আইইএলটিএস প্রশ্নপত্র বিক্রি করছিল।

 

এই গ্রেপ্তারের সূত্রপাত হয় ডেইলি সান পত্রিকার এক গোপন অনুসন্ধানের ভিত্তিতে। কয়েক মাস ধরে এই চক্রের কার্যক্রম খতিয়ে দেখার পর শনিবার পরীক্ষার কিছু ঘণ্টা পরই যৌথবাহিনী অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে।

 

পুলিশ জানায়, মামুন ও কেয়া পরীক্ষার আগের রাতে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের থাকার ব্যবস্থা করত। এরপর শিক্ষার্থীদের ফাঁস হওয়া প্রশ্নে কোচিং করিয়ে পরীক্ষার দিন বিভিন্ন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হতো। অভিযানে ৮ লাখ ৩৮ হাজার টাকা নগদ ও আটটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।

 

শিক্ষার্থীরা জানায়, এই চক্রের দেওয়া উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষায় গিয়ে তারা কাঙ্ক্ষিত ব্যান্ড স্কোর পেয়েছে, যা আইইএলটিএস পরীক্ষার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

 

মাসের পর মাস তদন্ত:

 

ডেইলি সান জানুয়ারি থেকে এই প্রশ্নফাঁস চক্রের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছিল। এতে মিরাজ হোসেন, প্রিন্স, মেহেদি, গিয়াস ও তারেক আজিজসহ অন্তত পাঁচজনের নাম উঠে আসে।

 

একজন প্রতিবেদক এপ্রিল মাসে গোপনে উত্তরা’র হোটেল অ্যাফোর্ড ইন-এ অবস্থান করলে দেখা যায়, প্রায় ১০০ শিক্ষার্থী সেখানে রাখা হয়েছে। মধ্যরাতে তাদের হাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন তুলে দেওয়া হয়। এরপর মাইক্রোবাস, সিএনজি বা মিনিবাসে করে প্যান্থপথের প্যাট্রোনাস, বনানীর কম্পাস, ধানমন্ডির আইএলসি, উত্তরার পেনস্টোনসহ বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো হয়।

২৩ মে মোটিজিলে হোটেল সেন্ট্রাল ইন-এও একই ধরনের ঘটনা ধরা পড়ে। সেখানে ১২০–১৩০ শিক্ষার্থীকে প্রস্তুত করা হচ্ছিল। ২৪ মে সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে ডেইলি সান পরীক্ষার প্রশ্ন হাতে পায়, অথচ পরীক্ষা শুরু হয় দুপুর ১টায়। পরে শিক্ষার্থীরা নিশ্চিত করে যে তাদের উত্তর ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে।

 

এই সেবার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১.২৫ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হতো।

 

একজন শিক্ষার্থী, মো. আল আমিন মিয়া জানান, “দলে যোগ দিতে আমাকে ২.২০ লাখ টাকা দিতে হয়েছে।”

আরেকজন, অর্শাদুর রহমান বলেন, “আমি ১.৪ লাখ টাকা খরচ করেছি কাঙ্ক্ষিত ব্যান্ড স্কোর পাওয়ার জন্য।”

 

কেবল শিক্ষার্থী নয়, সরকারি কর্মকর্তারাও এই ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সুবিধা নিয়েছেন। যেমন—শৈলেন চাকমা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার, জানিয়েছেন তিনি ২ লাখ টাকা দিয়েছেন। তার উত্তরও ১০০% মিলেছে।

 

সর্বশেষ চক্র ও মামুন-কের গ্রেপ্তার:

 

সাম্প্রতিক ঘটনায় শিক্ষার্থী নাদিত হাসান রকি বলেন, “আমি ফেব্রুয়ারি থেকে মামুন স্যারের কাছে কোচিং নিচ্ছিলাম। তিনি আমাকে পরীক্ষার আগের রাতে রিডিং, রাইটিং আর লিসনিং-এর আসল উত্তর দেওয়ার প্রস্তাব দেন। প্রথমে বিশ্বাস করিনি, পরে রাজি হই। প্রশ্ন ১০০% মিলেছে।”

 

রকি ১.৮ লাখ টাকা পরিশোধ করেন, আর অনেকেই ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন।

 

চক্রের কার্যপদ্ধতি:

 

ডেইলি সানের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এই চক্র কিছু জনপ্রিয় কোচিং সেন্টার ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত। তারা শিক্ষার্থী জোগাড় করে কমিশন পেত।

 

প্রথমে কেবল আইইএলটিএস-এর রেজিস্ট্রেশন ফি (আগে ২৪,৯৫০ টাকা, বর্তমানে ২৮,৪৫০ টাকা) নেওয়া হতো। এরপর শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট তারিখ জানানো হতো।

 

শুক্রবার জুমার নামাজের পর শিক্ষার্থীদের হোটেলে নিয়ে যাওয়া হতো। মোবাইল-ঘড়ি-ইয়ারফোনসহ সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস জমা দিতে হতো। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কড়া নজরদারিতে রাখা হতো। রাত ১টার পর পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর সরবরাহ করা হতো।

 

প্রথমে রাইটিং, এরপর রিডিং, তারপর লিসনিং প্রশ্ন দেওয়া হতো, যাতে শিক্ষার্থীরা পর্যাপ্ত সময় পায় মুখস্থ করার জন্য। পরদিন সকালে মাইক্রোবাস বা মিনিবাসে করে সরাসরি পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো হতো।

 

এজেন্ট তারেক আজিজের ভূমিকা:

 

তদন্তে জানা যায়, তারেক আজিজও প্রশ্ন বিক্রির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি একজন সাংবাদিককে বলেন, এক শিক্ষার্থীর জন্য ২.৭০ লাখ টাকা দিতে হবে এবং দাবি করেন যে ২০১৯ সাল থেকে এই ব্যবসা চলছে।

 

তিনি আরও বলেন, কেমব্রিজ ইংলিশ, আইডিপি বাংলাদেশ ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য তিনি ২.৫ কোটি টাকা খরচ করেছেন।

 

পরীক্ষা কর্তৃপক্ষ কী বলছে:

 

বাংলাদেশে আইইএলটিএস পরীক্ষা পরিচালনা করে ব্রিটিশ কাউন্সিল ও আইডিপি এডুকেশন।

 

আইডিপি বাংলাদেশের আইইএলটিএস অপারেশনের প্রধান এলোরা শাহাব শারমিন বলেন, “প্রোটোকল অনুযায়ী আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করার অনুমতি রাখি না। এ ধরনের বিষয় গ্লোবাল মিডিয়া টিম দেখে।”

 

ব্রিটিশ কাউন্সিলের ফুলার রোড অফিসে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

 

শনিবারের অভিযান:

 

শুক্রবার রাতে মামুন ও তার সহযোগীরা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নাড্ডার হোটেল ওয়েস্ট ভ্যালি ও বনানীর অ্যামাজন লিলি লেক ভিউতে রাখে। রাতে শিক্ষার্থীদের ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দেওয়া হয় এবং কোচিং করানো হয়।

 

শনিবার সকালে শিক্ষার্থীদের কম্পাস এডুকেশন, সল্ট ল্যাব–ইংলিশ, অপরচুনিটি জেএফপি শাখা এবং ব্রিটিশ আমেরিকান রিসোর্স সেন্টারসহ বিভিন্ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

 

পরীক্ষার পর মামুন অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহের সময় সাংবাদিককে মারধর করার চেষ্টা করলে স্থানীয়রা ও হোটেল সিকিউরিটি তাকে আটকে পুলিশে দেয়।

 

বানানী থানার ওসি মো. রাসেল সরোয়ার বলেন, “আমরা তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছি। মামুন খান ও কেয়াকে গ্রেপ্তার করে রবিবার আদালতে পাঠানো হয়েছে।”

 

দেশের ভাবমূর্তির জন্য হুমকি:

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু গ্রেপ্তার নয়—এখন প্রয়োজন সম্ভাব্য ভেতরের লিক তদন্ত করা, অস্বাভাবিক ফলাফল অডিট করা এবং কোটি কোটি টাকার লেনদেন ট্র্যাক করা।

টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “যদি আইইএলটিএস প্রশ্নফাঁস প্রমাণিত হয়, তবে বাংলাদেশে আইইএলটিএস সেন্টার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ব্রিটিশ কাউন্সিল ও আইডিপি এর দায় এড়াতে পারে না। প্রশ্নপত্র কেমব্রিজ থেকে সব দেশে একইভাবে আসে, তাই এ দায় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রযোজ্য।”

 

তিনি আরও বলেন, “আমাদের দেশে স্থানীয় পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস দুর্ভাগ্যজনকভাবে রুটিনে পরিণত হয়েছে। তবে আইইএলটিএস প্রশ্নফাঁস সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। এর পেছনে ভেতরের সংশ্লিষ্টতা না থাকলে এমন ঘটনা সম্ভব নয়।