শরতের নরম রোদ আর স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় বিরল এক সৌন্দর্যের দেখা মিললো চীনের শায়ানসি প্রদেশের আকাশে। কমলা রঙের গোলাপি ডানার ক্রেস্টেড আইবিস আর লম্বা লাল ঠোঁটের ব্ল্যাক স্টর্ক—এই দুই দুর্লভ পাখিগুলোর পাহাড়, জঙ্গল আর নদীর ওপর দিয়ে উড়ে বেড়ানোর দৃশ্য দেখে যেন মনে হয় প্রকৃতির বুকে রঙের ছিটা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
একসময় বিলুপ্তির মুখে থাকা এ প্রজাতিগুলো টিকে আছে চীন সরকারের দীর্ঘ সংরক্ষণ প্রচেষ্টায়। একসময় প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ক্রেস্টেড আইবিসকে বলা হয় ‘অরিয়েন্টাল জেম।’ হানচোং শহরের সিসিয়াং, মিয়ানসিয়ান ও ফোপিংয়ের জঙ্গলে এখন দল বেঁধে বিশ্রাম নিতে দেখা যায় তাদের। নীল আকাশ, সবুজ গাছ আর তাদের গোলাপি ডানার রং—মিলে যেন এক নিঃশব্দ চিত্রকলা। বহু বছরের যত্নে ফোপিং কাউন্টিতে আইবিসের সংখ্যা এখন শতাধিক। ছোট্ট এই এলাকা হয়ে উঠেছে তাদের নিরাপদ আশ্রয়। স্বচ্ছ নদীর জলে ধীর পায়ে হাঁটে ব্ল্যাক স্টর্ক—কালো পালক, সাদা বুক আর লাল রঙের পা ও ঠোঁটের তীক্ষ্ণ সৌন্দর্য নিয়ে। শরতের রঙিন পাহাড়ের পাশে তাদের উপস্থিতি প্রকৃতিকে আরও প্রাণময় করে তোলে।
ইয়েলো সির বিস্তৃত জলাভূমি প্রতি বছরই লাখ লাখ পরিযায়ী পাখির আশ্রয় হয়ে ওঠে। চিয়াংসুর তিয়াওচিনি এলাকাও সেই পথের এক গুরুত্বপূর্ণ বিরতি—যেখানে থামে ক্লান্ত পাখিদের ডানা, যেখানে জমে ওঠে প্রকৃতির শান্ত সুর। নানচিং ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটির গবেষক ফাং চ্য জানালেন, তিয়াওচিনি এলাকায় বসন্ত, শরৎ বা শীত—যে কোনো মৌসুমেই পাখিরা আসে। শোরবার্ড প্রজাতির পাখি এখানে যাত্রাপথেয় বিশ্রাম নেয়, আর অ্যানাটিডি প্রজাতির পাখিরা শীতকাল কাটাতে আসে, কারণ এই এলাকায় তাদের প্রচুর খাবার আছে। ২০২৪ সালে ইয়েলো সি’র বোহাই উপসাগর উপকূলের পরিযায়ী পাখির অভয়ারণ্য ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় যুক্ত হয়েছে। এদিকে চিয়াংসুর ইয়ানছেংয়ের জলাভূমিও দেখাচ্ছে—কীভাবে উন্নয়নের পাশাপাশি প্রকৃতিকেও রক্ষা করা যায়। ইয়ানছেং শহর এই জলাভূমির অভিভাবকের ভূমিকা নিয়েছে। গবেষক ও আলোকচিত্রীরা বছরের পর বছর পাখিদের চলাচল, সংখ্যা ও আচরণের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে চলেছে। ২০২০ সালে এখানে তৈরি হয় ‘৭২০ হাইল্যান্ডস” নামের একটি আকুয়াকালচার প্রকল্প। ৪৮ হেক্টরের সেই উঁচু ভূমিটি আজ পরিযায়ী পাখিদের একটি নিরাপদ অস্থায়ী আশ্রয়। উন্নয়ন আর প্রকৃতি রক্ষা—দুটি বহুদিন ধরে বিপরীতে থাকলেও চীনের ১৪তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দেখিয়েছে, চাইলে দুটি একসঙ্গেই চলতে পারে। শাংহাই থেকে দুই ঘণ্টার দূরত্বে থাকা ইয়ানছেং এখন চীনের শীর্ষ ৫০টি অর্থনৈতিক শহরের একটি। তারপরও ২০২৪ সালে সেখানে পাখির প্রজাতি সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪৭টিতে। এছাড়া শীতকালীন অভিবাসন মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথে, পূর্ব চীনের শানতোং প্রদেশ, উত্তর চীনের হ্যপেই প্রদেশ এবং ইয়েলো রিভারের জলাভূমিতে এসেছে হাজার হাজার রাজহাঁস। পূর্ব চীনের শানতোং এবং উত্তর চীনের হ্যপেই প্রদেশের আকাশ ও জলাভূমি এখন রাজহাঁসের খেলায় মাতোয়ারা। শানতোংয়ের ওয়েইহাই শহরে, রোংছেং হুপার রাজহাঁস জাতীয় প্রকৃতি সংরক্ষণ ক্ষেত্রকে এবার অভ্যর্থনা জানিয়েছে দুই হাজারেরও বেশি হুপারস রাজহাঁস। তাদের জলনৃত্য ও দলবদ্ধ খেলায় শানতোংয়ের আকাশ এখন মুখর। স্থানীয় কর্তৃপক্ষও রাজহাঁসদের সামলাতে প্রস্তুত। তাদের জন্য বিশেষ জাতের ঘাস লাগানো থেকে শুরু করে, প্রাকৃতিক জলাভূমি পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং প্রায় ৮৩ হেক্টর জুড়ে থাকা সিগ্রাস বেড সংরক্ষণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া নজর রাখা হচ্ছে রাজহাঁসগুলোর খাদ্য সরবরাহ, নিয়মিত জীবাণুনাশক ছিটানো, রোগ পর্যবেক্ষণ ও কর্মী প্রশিক্ষণের দিকেও। হ্যপেইয়ের হেংশুই লেকে এবার প্রথমবারের দেখা মিলেছে ১২টি তুন্দ্রা রাজহাঁসের। স্থানীয় প্রকৃতি সংরক্ষণ দপ্তরের উপ-পরিচালক চাং ইউকুয়াং জানালেন, এই বছর তুন্দ্রা রাজহাঁস আগেভাগে এসেছে, যা সরাসরি এই বছরের আবহাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। রাজহাঁসের সঙ্গে এসেছে বৈকাল হ্রদের বালি হাঁস, ডালমেশিয়ান পেলিকান। এই প্রাকৃতিক অভয়ারণ্যটি উত্তর চীনের জলাভূমি, খোলা জল, কাদা ও বনকে গেঁথেছে এক সুতোয়। ৮০টিরও বেশি প্রজাতির প্রায় ২০ হাজার পরিযায়ী পাখি আছে এখানে। মধ্য চীনের শানমেনসিয়ার ইয়েলো রিভারের জলাভূমিতেও রাজহাঁসের আগমন শুরু হয়েছে। মঙ্গোলিয়া ও সাইবেরিয়ার প্রজননভূমি থেকে তারা এ জায়গায় এসেছে শীত কাটাতে। স্থানীয় জলাভূমি পার্কে পর্যবেক্ষণ এবং পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। পাখিদের গতিবিধি শনাক্ত করতে স্থাপন করা হয়েছে ড্রোন–সেন্সর।
ফয়সল/শুভ তথ্য ও ছবি: সিসিটিভি