এ এইচ সবুজ, গাজীপুর : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)'র সাবেক জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও পাট মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আ.স.ম হান্নান শাহ্'র ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। বিএনপি'র বর্ষিয়ান সাবেক নেতা হান্নান শাহ্ ছিলেন কাপাসিয়া তথা সমগ্র দেশের বিএনপি'র নেতা-কর্মীদের অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষের আপনজন।
২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক মিথ্যা মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়ার পথে অসুস্থ্য হয়ে পড়লে প্রথমে তাকে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) এ ভর্তি করা হয়। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে ১১ সেপ্টেম্বর তাকে সিঙ্গাপুরের র্যাফেলস হার্ট সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে তার হৃদযন্ত্রের অস্ত্রোপাচার করা হয়। আ.স.ম হান্নান শাহ্ দীর্ঘ ২১ দিন জীবন-মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
এ উপলক্ষে আজ শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) গাজীপুরের কাপাসিয়ায় তাঁর নিজ গ্রাম ঘাগটিয়ায় তাঁর কবরে জেলা ও উপজেলা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা দলে দলে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এদিন বাদ আসর মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনায় পারিবারিকভাবে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
এছাড়াও আগামী ১১ অক্টোবর বিকেল তিনটায় ব্রি.জে.(অব:) আ.স.ম হান্নান শাহ্ স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে ও উপজেলা বিএনপি'র আয়োজনে কাপাসিয়া সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া ও স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বিএনপি'র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থাকবেন বলে জানিয়েছেন প্রয়াত হান্নান শাহ্'র ছোট ছেলে গাজীপুর জেলা বিএনপি'র যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ্ রিয়াজুল হান্নান (রিয়াজ) এবং তার পিতার আত্মার মাগফিরাত কামনায় তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।
হান্নান শাহ্ ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর কাপাসিয়া উপজেলার ঘাগুটিয়া গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পুরো নাম আবু সাঈদ মতিউল হান্নান শাহ্। তাঁর বাবার নাম ফকির আবদুল মান্নান শাহ্। তাঁর বাবা ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় এর্টনী জেনারেল ছিলেন। এছাড়াও তাঁর ছোট ভাই শাহ্ আবু নাঈম মমিনুর রহমান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জেষ্ঠ বিচারপতি ছিলেন।
এদিকে শাহ্ আবু নাঈম মমিনুর রহমান বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আ.স.ম হান্নান শাহ্'র স্ত্রীর ছিলেন মরহুমা নাহিদ হান্নান। এই দম্পতির রয়েছে দুই ছেলে ও এক মেয়ে।মেয়ে শারমিন হান্নান সুমি এবং বড় ছেলে শাহ্ রেজাউল হান্নান ও শাহ্ রিয়াজুল হান্নান।
এদিকে হান্নান শাহ্ ১৯৫৬ সালে ঢাকার সেন্টগ্রেগরি স্কুল থেকে মেট্রিকোলেশন পাস এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬০ সালে বিএসসি অধ্যয়ণকালে পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।
১৯৬২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়া হান্নান শাহ্ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অন্য বাঙ্গালি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে ফিরে পুনরায় তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এইচ এম এরশাদ সরকারের সময় তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একদল বিপথগামী সেনা সদস্যদের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর বিএনপি'র ক্রান্তি কালে তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে জিয়াউর রহমানের লাশ উদ্ধার করে ঢাকায় নিয়ে আসেন তৎকালীন ব্রি. জে. আ.স.ম হান্নান শাহ্।
এছাড়াও হান্নান শাহ্ বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ১৯৮৩ সালে বিএডিসির চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে বিএনপিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন।
রাজনৈতিক জীবনে শুরুতে ১৯৮৩ সালে হান্নান শাহ্ ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক, ১৯৮৬-১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ) এবং গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯১ সালে গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩-২০০৯ সাল পর্যন্ত দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৯ সালের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলে তাকে বিএনপি’র সবোর্চ্চ ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে তার এই পদ বহাল ছিলো।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে তৎকালীন বহুল আলোচিত ড.ফখরুদ্দিন আহমদ ও সাবেক সেনা প্রধান মঈন উদ্দিনের সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গণতন্ত্র বিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সর্ব প্রথম মুখ খোলে কথা বলেছিলেন। তখন বিএনপি'র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে দেশ ত্যাগ ও শেখ হাসিনাকে দেশে আসতে না দেয়ার ভূমিকার ব্যাপক সমালোচনা করেন।
গণমাধ্যমে তখন সরকারের সমালোচনার কারনে বার বার হান্নান শাহ্কে কারাগারে যেতে হয়েছে। দলের এ ক্রান্তিকালে সক্রিয় ভূমিকার কারনে তাকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মনোনীত করেন।
বর্ষিয়ান এই রাজনীতিবিদ একাধারে ছিলেন কৃতি ফুটবলার, পাশাপাশি হকি ও গল্ফ খেলোয়াড় হিসেবে ছিলেন পারদর্শী। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকার ওয়ান্ডার্স ক্লাবের গোল রক্ষক ছিলেন। তিনি বক্সিংয়ে সেনাবাহিনীতে রেকর্ডও তৈরী করেছিলেন।
বাংলাদেশ সুটিং ফেডারেশনের সভাপতিও ছিলেন। তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে পৃথিবীর ৫০ টির মত দেশ ভ্রমন করেছেন।
কাপাসিয়ার সাধারণ মানুষের চোখে হান্নান শাহ্ ছিলেন কাপাসিয়ার উন্নয়নের রূপকার। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এলাকার স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার উন্নয়নে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল।
বিশেষ করে স্থানীয় শীতলক্ষ্যা বানার নদীর উপর তার নির্মিত 'ফকির মজনু শাহ' সেতু স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ফকির মজনু শাহ্ ছিলেন তৎকালীন ফকির আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তাঁর নামানুসারেই এই সেতুর নামকরণ করা হয়।