খবর

সড়কবাতি স্থাপনে ব্যয় ৪৩ কোটি টাকা : কাপাসিয়ায় ৯০ ভাগ সড়কবাতিই অচল

কাপাসিয়ায় ৯০ ভাগ সড়কবাতিই অচল
কাপাসিয়ায় ৯০ ভাগ সড়কবাতিই অচল
কাপাসিয়ায় ৯০ ভাগ সড়কবাতিই অচল
এ এইচ সবুজ, গাজীপুর: গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক ও জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রায় ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত সৌর বিদ্যুৎ চালিত সড়ক বাতিগুলোর শতকরা ৯০ ভাগই অচল হয়ে পড়েছে। এ সড়ক বাতিগুলোর বেশিরভাগ স্থানেই নেই খুঁটি, প্যানেল, লাইট ও ব্যাটারির অস্তিত্ব। যাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান তাদের অনেক জায়গায় খুঁটি থাকলেও লাইটগুলো চুরি হয়ে গেছে। আবার কোথাও লাইট থাকলেও প্যানেল গায়েব। কোন কোন জায়গায় খুঁটি এবং লাইট থাকলেও নেই ব্যাটারি। 
 
রাস্তার পাশে স্থাপন করা এসব সৌরবাতির বর্তমানে দেখভালের দায়িত্ব কার এমন প্রশ্ন এখন স্থানীয় সাধারণ মানুষের। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন কিংবা জনপ্রতিনিধিদেরও কার্যকর কোন ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছেনা। অভিযোগ রয়েছে, সড়কবাতি স্থাপনের পর থেকে তিন বছর পর্যন্ত তদারকির কথা থাকলেও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেনি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। 
 
প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব সৌরবাতি সচল না থাকায় রাতের অন্ধকারে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকার হাজার হাজার মানুষকে। ফলে এসব এলাকায় রাতের বেলা চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ ও মাদকাসক্তদের অবাধ বিচরণ বেড়ে গেছে। 
 
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির আওতায় টিআর-কাবিটা বরাদ্দের মাধ্যমে উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে রাতের বেলা পথচারীদের চলাচলের সুবিধার্থে বিভিন্ন গ্রামীণ হাট- বাজার ও গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা,মসজিদ,মন্দির,স্কুল, কলেজসহ নানা প্রতিষ্ঠানের সামনে এসব সৌরবাতি স্থাপন করা হয়। 
 
২০১৬-১৭ অর্থ বছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থ বছর পর্যন্ত ৪২ কোটি ৮৬ লাখ ৯ হাজার ২৩১ টাকা ব্যয়ে ৭৪৬ টি সৌরবিদ্যুৎ চালিত সড়কবাতি স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে টিআর প্রকল্পের আওতায় ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ৮২৬ টাকা ব্যয়ে ৫৪টি সড়কবাতি স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে টিআর প্রকল্পের আওতায় ২১ লাখ ৬৩ হাজার ৬৩ টাকা ব্যয়ে ৬৪টি সড়ক বাতি স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে প্রথম ধাপে টিআর প্রকল্পের আওতায় ২৩ লাখ ২৬ হাজার ৬৮১ টাকা ব্যয়ে ৫৮টি বাতি এবং কাবিটা প্রকল্পের আওতায় ৩১ লাখ ৬৭ হাজার ৭৭৬ টাকা ব্যয়ে ৭১টি বাতি স্থাপন করা হয়েছে। একই অর্থ বছরে দ্বিতীয় ধাপে টিআর প্রকল্পের আওতায় ২৩ লাখ ২৭ হাজার ৮৩২ টাকা ব্যয়ে ৬০টি বাতি এবং কাবিটা প্রকল্পের আওতায় ৩১ লাখ ৬৯ হাজার ১৭৫ টাকা ব্যয়ে ৭৪টি বাতি স্থাপন করা হয়েছে। ওই অর্থ বছর নির্বাচন উপলক্ষে প্রথম ধাপে টিআর প্রকল্পের আওতায় ৫১ লাখ ৬২ হাজার ১৭০ টাকা ব্যয়ে ৭৭টি বাতি স্থাপন করা হয়েছে। 
 
একই অর্থ বছরে নির্বাচন উপলক্ষে দ্বিতীয় ধাপে টিআর প্রকল্পের আওতায় ৫১ লাখ ৬২ হাজার ১৭০ টাকা ব্যয়ে ৬৬টি বাতি স্থাপন করা হয়েছে এবং কাবিটা প্রকল্পের আওতায় ৫৬ লাখ ৬৪ হাজার ৪০০ টাকা ব্যয়ে ৭৬টি বাতি স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে নির্বাচন উপলক্ষে টিআর প্রকল্পের আওতায় ৪২ লাখ ৭২ হাজার ৮৮৮ টাকা ব্যয়ে ৭৩টি বাতি এবং কাবিটা প্রকল্পের আওতায় ৪৪ লাখ ৮ হাজার ২৫০ টাকা ব্যয়ে ৭৩টি বাতি স্থাপন করা হয়েছে। 
 
বিভিন্ন অর্থ বছরে অথবা একই অর্থ বছরে একই প্রকল্পের আওতায় সমপরিমাণ টাকায় ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যক, আবার কম টাকায় বেশি সংখ্যক ও বেশি টাকায় কম সংখ্যক সৌরবাতি স্থাপনের তথ্য বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সৌরবাতি স্থাপনের নামে তৎকালীন স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও যুবলীগের প্রভাবশালী নেতারা বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। যার ফলে এ বাতিগুলো স্থাপনের পর থেকেই রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির প্রতি তেমন কোন গুরুত্ব ছিল না সংশ্লিষ্টদের। 
 
নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক ঘাগটিয়া চালা বাজারের একজন ব্যবসায়ী জানান, গত কয়েকদিন আগে রাতের বেলা এ বাজার সংলগ্ন সেতুর পূর্বপাশে একটি ঔষুধ কোম্পানির ওষুধ সরবরাহকৃত কাভার্ডভ্যান আটকে বিক্রয় প্রতিনিধিকে দেশীয় অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তার ব্যাগে থাকা সব টাকা ছিনতাইকারীরা নিয়ে যায়। কয়েক বছর আগে এখানে একটি সড়কবাতি স্থাপন করা হলেও তা বেশি দিন টেকসই হয়নি।
 
চালা বাজার থেকে আড়ালিয়া সড়কে চলাচলকারী বেশ কয়েকজন অটোরিকশা চালক জানান,আগে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে সড়কবাতি থাকাকালে গভীর রাত পর্যন্ত তারা যাত্রীদের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দিতেন। কিন্তু সড়কবাতিগুলো না থাকায়, এখন তারা ভয় পায়। প্রায়ই মাদকাসক্ত ও ছিনতাইকারীরা এ সড়কে রিকশা আটকে টাকা পয়সা নিয়ে যায় এবং অনেক সময় চালককে মারধর ও অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রিকশাও নিয়ে যায়। তাই সন্ধ্যার পর এই সড়কে রিকশা চালাতে তাদের ভয় করে।
 
স্থাপনকৃত সড়কবাতিগুলোর অধিকাংশই অচল থাকার বিষয়টি স্বীকার করে কাপাসিয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো: মশিউর রহমান জানান, গ্রামীণ মানুষের রাতের বেলা নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য এটি খুবই উপকারি একটি প্রকল্প ছিলো। কিন্তু এই প্রকল্পটির কাজ এখন বন্ধ রয়েছে। আর যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই সড়কবাতিগুলো স্থাপন করা হয়েছিল, তাদের চুক্তির মেয়াদও ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে সৌর বাতিগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য কোন বরাদ্দ না থাকায় আপাতত কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না। 
 
তিনি আরো বলেন, বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
 
এ বিষয়ে দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ ওহাব খান খোকা বলেন, এ প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভালো হলেও এর সাথে যারা জড়িত ছিলেন তারা শুরু থেকেই লুটতরাজের আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্নমানের ব্যাটারি, সোলার প্যানেল,লাইট ও খুটিগুলো স্থাপনের অল্প দিনের মধ্যেই সেগুলো অচল হয়ে পড়েছিল। 
 
ফলে পুরো উপজেলা জুড়ে বর্তমানে ৫০টি সচল সৌরবাতি পাওয়া যাবে বলেও মনে হয় না। তাছাড়া স্থানীয় মাদকাসক্ত যুবক ও চুরি-ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত অপরাধ চক্রের সদস্যরাও এগুলোর বিভিন্ন সামগ্রি নিয়ে যাওয়ার ফলে জনগণের তেমন কোন উপকার হয়নি। তাই সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির অভাবে সরকারের এই বিশাল অংকের টাকার পুরোটাই অপচয় হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
 
এ বিষয়ে কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তামান্না তাসনিম বলেন, রাতের বেলা গ্রামীণ জনগণের চলাচল ও চুরি ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড প্রতিরোধে এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ ছিলো। কিন্তু নিন্মমানের সামগ্রি ব্যবহারের কারণে সরকারের এই প্রকল্পটা পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছে। 
 
বর্তমানে কাপাসিয়াতে সচল (আলো দেয়) সৌর সড়কবাতির সংখ্যা খুবই কম। বলতে গেলে ৯০-৯৫ শতাংশেরও বেশি সড়কবাতিই অচল পড়ে রয়েছে। এখন সরকার যদি মনে করে এ প্রকল্পটি আবারো বাস্তবায়ন করা হবে, তবে কাপাসিয়ার পরিসংখ্যান তুলে ধরে সেগুলো মতামতের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।