গাজীপুরের কাঁঠাল স্বাদ-মিষ্টি গন্ধে অতুলনীয়, পেলো জিআই স্বীকৃতি
কাঁঠাল রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের অন্তত ১৫টি দেশে।

এ এইচ সবুজ, গাজীপুর: কাঁঠাল গ্রীস্মের প্রিয় ফল, রসে ভরা ও মনভোলা। গন্ধেও মাতোয়ারা, স্বাদেও অতুলনীয় গাজীপুরে উৎপাদিত কাঁঠাল। এদিকে ‘প্রকৃতির মিষ্টি রস, কাঁঠালে ভরপুর দেশ’ কথাটির সাথে পুরোপুরি মিলে যায় গাজীপুরের নাম।
রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে সবুজে ঘেরা গাজীপুর যেন এখন কাঁঠালের রাজ্য। রাস্তার দুই পাশে, বাজারে, বাড়ির আঙিনায় যেদিকে চোখ যায়, শুধুই কাঁঠাল। দেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল এবার পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের মর্যাদা, আর সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে এ জেলায় উৎপাদিত বিখ্যাত কাঁঠালের নাম।
আকার-আকৃতি, স্বাদ, ঘ্রাণেও অনন্য এই কাঁঠাল দীর্ঘদিন ধরেই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের বাজারেও জায়গা করে নিয়েছে। এখন নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের অন্তত ১৫টি দেশে। স্থানীয় প্রশাসনও জেলার শ্রীপুরের কাঁঠালকে ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করতে নিয়েছে নানা উদ্যোগ। ইতোমধ্যে শ্রীপুর উপজেলা চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল কাঁঠালের ভাস্কর্য, যার স্লোগান ‘সবুজে শ্যামলে শ্রীপুর, মিষ্টি কাঁঠালে ভরপুর’।
প্রতি বছর মে-জুন মাসে শ্রীপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয় কাঁঠালের মৌসুম। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত জমে ওঠে কাঁঠালের বাজার। জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় কাঁঠালের হাট বসে জৈনা বাজার এলাকায়। শ্রীপুরের চকপাড়া, টেপিরবাড়ি, রাজাবাড়ি, চন্নাপাড়া, কেওয়া এবং কাপাসিয়ার বেগুনী বাজার, আমরাইদ, চৌকারচালা, আড়াল বাজার, বারিষাব (বেলতলী) সহ আরো অনেক এলাকায়ও বসে বড়-ছোট বাজার। এসব হাটে আসেন রাজধানীর কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, হেমায়েতপুর ও উত্তরার পাইকাররা।
এখানকার কাঁঠাল চাষিরা প্রতিদিন গাছ থেকে কাঁঠাল সংগ্রহ করে ঠেলাগাড়ি ও ভ্যানে করে বাজারে নিয়ে আসেন। বিকেল নাগাদ বাজারের পাশেঈ সারি সারি ট্রাকে তোলা হয় হাজার হাজার কাঁঠাল। দেশের বিভিন্ন জেলার চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও এসব কাঁঠাল চলে যায়। এই মৌসুমি ব্যস্ততায় জীবন্ত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
গাজীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গাজীপুর জেলায় মোট ৯ হাজার ১০৩ হেক্টর জমিতে কাঁঠালের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে শ্রীপুরে সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ৫৫২ হেক্টর জমিতে। জেলায় উৎপাদিত কাঁঠালের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।
এ অঞ্চলে খাজা, গালা ও দুরসা জাতের কাঁঠাল চাষ হয়। উঁচু জমি, বন্যামুক্ত পরিবেশ, ও অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এখানকার কাঁঠাল হয় বড়, মিষ্টি আর ঘ্রাণে ভরপুর।
শুধু দেশে নয়, গাজীপুরে উৎপাদিত এসব কাঁঠাল পাড়ি দিচ্ছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পাশাপাশি ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা থেকেও আসছেন ব্যবসায়ীরা, কেউবা সরাসরি বাগান থেকেই কাঁঠাল কিনে নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে স্থানীয় বেশকয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, শ্রীপুরের কাঁঠালের চাহিদা এখন বিশ্বব্যাপী। তবে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এত সম্ভাবনার জায়গায় এখনো কোনো হিমাগার নেই। শুধু সংরক্ষণের অভাবে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকার কাঁঠাল পচে যায়।
কাঁঠাল শ্রীপুর অঞ্চলের অন্যতম অর্থকরী ফসল হলেও চাষিদের নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়। অনেক বাজারে মৌসুমি ফলের জন্য নির্ধারিত স্থান নেই। ফড়িয়াদের দাপটে প্রকৃত দাম থেকে বঞ্চিত হন চাষিরা। নেই সরকারি প্রশিক্ষণ বা ব্যাংক ঋণের সুবিধাও।
কাপাসিয়া ও কালীগঞ্জ উপজেলার অনেক হাটেই নেই আলাদা কাঁঠাল বিক্রির জায়গা। এতে কৃষকদের হয়রানির শিকার হতে হয়। অথচ এখানেও ভালো ফলন হচ্ছে।
শ্রীপুরের বাগান মালিক আব্দুল মালেক বলেন, ‘সরকার যদি কাঁঠাল চাষে প্রশিক্ষণ দিত, সংরক্ষণের ব্যবস্থা করত, তাহলে বিদেশে আরো বেশি কাঁঠাল পাঠানো যেত।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘গাজীপুরের কাঁঠালের স্বাদ, গন্ধ ও গুণগত মানের দিক থেকে রয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং ই-কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ইডিসি)-এর সার্বিক সহযোগিতায় পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হয় জিআই স্বীকৃতির আবেদন।
তিনি আরো বলেন, পরবর্তীতে গত বছরের ৬ মার্চে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন, ২০১৩-এর ধারা ১২ অনুসারে, গাজীপুরের কাঁঠালকে জিআই জার্নাল-৪৬-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ৮ মার্চ এটি ডিপিডিটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। এতে করে কাঁঠাল বাংলাদেশের ৪৭তম নিবন্ধিত জিআই পণ্যে পরিণত হয়।
কৃষিবিদ আরো বলেন, ‘শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর কর্তৃক ‘বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস-২০২৫’ উপলক্ষ্যে বুধবার (৩০ এপ্রিল) বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমির মাল্টি পারপাস হলে একটি আলোচনা সভা ও ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আর সেই অনুষ্ঠানেই গাজীপুরের কাঁঠাল জিআই স্বীকৃতি পায়।
কাঁঠালের জিআই স্বীকৃতি শুধু একটি সম্মান নয়, এটি একটি সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। উপযুক্ত নীতিমালা, অবকাঠামো উন্নয়ন, হিমাগার স্থাপন ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে গাজীপুরের কাঁঠাল হতে পারে জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।